রোগী দেখছেন অরুণোদয় মণ্ডল। সুন্দরবনের ‘সুজন’-এ। -নিজস্ব চিত্র।
বিনামূল্যে হা-অন্ন মানুষদের চিকিৎসার নেশায় কলকাতা থেকে প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনে যান এক এমবিবিএস। ট্রেনে, ভ্যান রিক্সায়, ট্রেকারে চেপে, নৌকায় দু’-দু’টি নদী পেরিয়ে আর তার পর দেড় ঘণ্টা হেঁটে। হ্যাঁ, এই ৬৭ বছর বয়সেও। কাঁধে ওষুধবোঝাই তিনটি ব্যাগ নিয়ে। ফি সপ্তাহে এক বার। শনিবার। নিয়মিত। রবিবার রাতে ‘ব্যাক টু বাঙ্গুর’। সোমবার সকালেই যে খুলতে হবে বিরাটির চেম্বার।
অরুণোদয় মণ্ডলের লড়াইটা শুরু হয়েছিল চার দশক আগে। ১৯৮১-তে। যখন বিরাটিতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে খুলেছিলেন চেম্বার। ডাক্তার অরুণোদয় মণ্ডলের ফি ছিল ২ টাকা। কাছের মন্দিরে যখন তার কমে প্রণামীও জমা পড়ত না! দিনে এক জন কি দু’জন রোগী আসতেন। তাতেই খুশি অরুণোদয়, এ বছর পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘পদ্মশ্রী’ পদকজয়ীদের অন্যতম।
সুন্দরবনের চাঁড়ালখালি থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় পড়তে এসেছিলেন কলকাতার টাকি গভর্নমেন্ট কলেজে। তার পর ডাক্তারি পড়তে ঢুকলেন পার্ক সার্কাসের ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে’। এমবিবিএস হলেন ’৭৯-এ। এমডি হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। দু’-দু’বার ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রবেশিকা পরীক্ষায়। তার পরেই ১৯৮১-তে বিরাটিতে চালু হল দু’টাকার ফি-এর ‘মণ্ডল ডাক্তার’-এর চেম্বার।
কিন্তু চেম্বারে আশ মিটত না অরুণোদয়ের। বছর তিনেকের মধ্যেই চেম্বার রোগীদের ভিড়ে ভরে যাওয়ার পরেও। রক্তে যে তাঁর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নেশা! সেই নেশাতেই তাঁর দৌড় শুরু হল ২০০০ থেকে।
অরুণোদয় বললেন, ‘‘কলকাতার চিকিৎসকদের চেম্বারে চেম্বারে সপ্তাহভর ঘুরে জোগাড় করতাম ‘ডক্টরস্ স্যাম্পেলস্’। ভরে নিতাম তিনটি ব্যাগে। তার পর শিয়ালদহ থেকে ভোর পাঁচটা পাঁচের হাসনাবাদ লোকাল। দু’ঘণ্টার পথ। হাসনাবাদে নেমে ভ্যান রিক্সায় মিনিট কুড়ি। তার পর ডাঁশা নদী পেরতে হত নৌকায়। নেমে মিনিট কুড়ি ট্রেকারে চেপে পৌঁছতেন রায়মঙ্গল নদীর পাড়ে। নৌকায় নদী পেরিয়ে দেড় ঘণ্টা হেঁটে যেতাম চাঁড়ালখালিতে আমার গ্রামের বাড়িতে। কালিন্দি নদীর পাশে, সুন্দরবনে। ২০০ মিটার দূরে বাংলাদেশ। রোগী দেখতাম সেখানেই। বিনামূল্যে। কখনও রাতে, লন্ঠন, কুপি জ্বালিয়ে রোগী দেখেছি। বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি যে তখনও সুন্দরবনের সেই দুর্গম প্রান্তে।’’
রবিবার বিকেলে রওনা হতেন বিরাটি ফেরার জন্য। পরের দিন চেম্বার খুলতে হবে যে পনেরো টাকা ফি-এর ডাক্তারের। ২০০০ থেকে ২০০৬। ফি সপ্তাহের শনি ও রবিবার এটাই ছিল এমবিবিএস অরুণোদয়ের রুট। রুটিনও।
আরও পড়ুন- কলকাতার শীত এ বার নোবেলবর্ষী, শহরের লাভ হল কি!
অরুণোদয়ের লড়াইটা শুরু হয়েছিল তারও দু’দশক আগে। সুন্দরবন থেকে এসে ভর্তি হলেন টাকি গভর্নমেন্ট কলেজে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ঠিক আগেই মারা গেলেন বাবা। চাঁড়ালখালিতে কিছু জমিজমা ছিল বাবার। চাষবাসই ছিল সম্বল। বাবা মারা যাওয়ার পর অরুণোদয়ের কাঁধে চাপল বাকি তিন ভাই ও চার বোনের দায়িত্ব। সেই সব সামলাতেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পড়তে পড়তেই। সংসার টানতে, কলকাতায় ‘মেস’ বানিয়ে যেখানে থাকতেন। তার খরচ ও পড়াশোনার খরচ সামলাতে তিন বেলা টিউশন করতেন অরুণোদয়।
অরুণোদয়ের হাতে গড়া সুন্দরবনর ‘সুজন’। - নিজস্ব চিত্র।
সময়টা স্বাধীনতার পরের কয়েকটা বছরের নয়। এমবিবিএস পাশের পর যখন যে ভাবে হোক বিদেশি ডিগ্রি আর বাড়তি পসারের মোহে ছাত্রছাত্রীরা ছুটছেন লন্ডন, বার্কলে, পেনসিলভানিয়া, টরেন্টোয়। অত দূরে পৌঁছনো সম্ভব না হলে অন্তত মাদ্রাজ, বেঙ্গালুরু, দিল্লি বা পুণেয়।
অরুণোদয় সেই সব চেষ্টা করেননি।
তাঁর কথায়, ‘‘বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখিনি যে! টেনেছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নেশা। সেই সময় কাছেপিঠে, কখনও বা দূরে কোনও স্বাস্থ্যশিবির-টিবির হলে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হত। বিনামূল্যে রোগী দেখতে। সেই রোগী দেখতে গিয়েই আমার উপলব্ধি হল, এ ভাবে কাজের কাজ কিছুই হবে না। স্বাস্থ্যশিবিরে গিয়ে যাঁদের দেখে আসছি, সেই রোগীরা আমার পরামর্শ মেনে চলছে কি না, আমার প্রেসক্রিপশন ওঁদের কাজে লাগছে কি না, তা নিয়ে কোনও ফলো-আপ তো করা হচ্ছে না!’’
ফলো-আপ করার জন্যই সুন্দরবনের চাঁড়ালখালির কথা মনে পড়ল তাঁর। কালিন্দি নদীর পাশে তাঁর নিজের গ্রাম। ২০০ মিটার দূরে নদী পেরলেই বাংলাদেশ। অরুণোদয় ভাবলেন, সেখানে গিয়েই প্রতি সপ্তাহে রোগী দেখবেন, বিনামূল্যে। প্রতি সপ্তাহে গেলে রোগীরা তাঁর পরামর্শ মেনে চলছেন কি না, সেই ফলো-আপও করা যাবে।
সেই শুরু। সালটা ২০০০। নতুন শতাব্দীতে পা দিয়ে ফি সপ্তাহে বিরাটি থেকে চাঁড়ালখালি আর সেখান থেকে বিরাটিতে ট্রেনে, বাসে আসা যাওয়া শুরু হল অরুণোদয়ের। সেখানে গ্রামের বাড়িতেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেখতেন সব ধরনের রোগী। সেই ভাবে কয়েক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর বুঝলেন, তাতেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ, তাঁর লেখা প্রেসক্রিপশন মেনে চলতে পারছেন না রোগীরা। দামি ওষুধ কিনতে পারছেন না বলে।
ফলে, অন্য ভাবে ভাবতে শুরু করলেন অরুণোদয়। আক্ষরিক অর্থেই, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। বুঝলেন, শুধুই বিনামূল্যে রোগী দেখলে চলবে না। রোগীদের ওষুধও দিতে হবে, বিনামূল্যে।
রোগীর ভিড়। সুন্দরবনের ‘সুজন’-এ। - নিজস্ব চিত্র।
অরুণোদয় বললেন, ‘‘কিন্তু সেই ওষুধ কিনতে গেলে তো অনেক টাকা লাগবে। সেই টাকা জোগাড় করব কী ভাবে? বিরাটির প্রতিবেশীদের বললাম। বন্ধু, আত্মীয়দের বললাম। ওঁরা টাকা জোগাড় করে দিতে শুরু করলেন। সেই টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে নিয়ে তখন আমি সপ্তাহের শেষে ফি শনিবার যেতাম চাঁড়ালখালিতে। কাঁধে ওষুধবোঝাই তিন-তিনটি ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু কতই বা লোকজনের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করা যায়। তা-ও আবার হামেশাই। তাই অন্য পথ ধরতে হল। সারা সপ্তাহ কলকাতার ডাক্তারদের চেম্বারে চেম্বারে ঘুরে যে ‘ডক্টরস্ স্যাম্পেল্স’ জোগাড় করতাম, তাদের মধ্যে কোনটা ‘এক্সপায়ার্ড’ হবে হবে করছে, সেই সব বেছেবুছে ব্যাগে ভরে রওনা হতাম চাঁড়ালখালি। তাতেও সমস্যা থেকে গেল। যে রোগীর সপ্তাহে পাঁচ দিনের ওষুধ লাগে, তাঁকে বড়জোর দু’দিনের ওষুধ দিতে পারছিলাম। তার উপর ছিল বিষধর সাপের ছোবলে প্রাণ হারানোর ভয়। সুন্দরবনে আমার বাড়ির ওখানে যে খুব সাপের উপদ্রব।’’
আরও পড়ুন- এ বার সব ক্যানসার সারবে একই উপায়ে? যুগান্তকারী আবিষ্কার
না, সরকার পাশে দাঁড়ায়নি। ডান-বাম কোনও সরকারই নয়, জানালেন অরুণোদয়। ফলে, সুন্দরবনেরই একটি এলাকায় ১১ কাঠা জমি কিনলেন তিনি। গড়ে তুললেন দোতলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ‘সুজন’। পাকা বাড়ি। সেখানে গিয়েই রোগী দেখতে শুরু করলেন, ২০০৬ সাল থেকে। এমনকি, প্রয়োজনে নিজের খরচে তাঁদের কলকাতায় এনে কম খরচে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, দরকার হলে কোনও হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে ভর্তি করিয়ে তাঁদের অস্ত্রোপচার করাতেও শুরু করলেন অরুণোদয়।
তাঁর কথায়, ‘‘এখন সেই ‘সুজন’-এ প্রতি শনি ও রবিবার তাঁকে দেখাতে আসেন গড়ে আড়াইশো রোগী। তাঁদের রক্ত ও অন্যান্য পরীক্ষাগুলি নমুনা নিয়ে এসে করানো হয় কলকাতার বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে। অর্ধেক খরচে।’’
কেন্দ্রীয় সরকারকে নিজেই জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনের কথা, অনলাইনে। ২০১৮-য়। তারই স্বীকৃতি মিলল দু’বছর পর। গত ২৫ জানুয়ারি ‘পদ্মশ্রী’ প্রাপকদের তালিকায় ঠাঁই পেল চিকিৎসক অরুণোদয় মণ্ডলের নাম। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy