কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আগে তাঁর নাম অনেকে জানতেন না। এখন তা অনেকে জানেন। এখন তাঁর নাম হয়েছে। পরিচিতি হয়েছে। খ্যাতিও হয়েছে অনেকাংশে। এই খ্যাতির পিছনে কাজ করেছে তাঁর ‘লড়াই’। বঞ্চিতদের হয়ে, বঞ্চিতদের জন্য তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন। তাঁর বিচার করার ‘স্টাইল’ ছিল ভিন্ন রকম। নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় তাঁর একের এক নির্দেশ আলোড়ন তৈরি করেছিল। ওই সব মামলার সূত্রেই বিচারপতি হিসাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সোমবার এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলার রায় মনে করিয়ে দিয়েছে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎকে। যিনি বলেছিলেন, নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে কোথাও দাগ রেখে যেতে চান। তবে অভিজিতের নির্দেশে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্ত সোমা দাস ছাড়া বাকিদের চাকরিও বাতিল হয়ে গেল সোমবারের রায়ে।
চাকরিপ্রার্থীদের কাছে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ‘মসিহা’ও ছিলেন বটে। তিনিই দুর্নীতি ধরবেন, তিনিই চাকরি পাইয়ে দেবেন, এমন ভরসাও ছিল অনেকের। কিন্তু একটা সময় পরে তাঁকে যাঁরা নায়ক মনে করেছিলেন, এমন অনেকের আশাভঙ্গ হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, অভিজিতের পথে হেঁটে বেআইনি চাকরি বাতিল করল হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চও। তাঁর দেওয়া চাকরি বাতিলের রায় বৈধতা তো পেলই, বরং আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নিল বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শাব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। কিন্তু অভিজিৎ কি বঞ্চিতদের লোক হয়ে থেকে যেতে পারলেন?
সোমবার রায় ঘোষণার আগের দিন, রবিবার অভিজিৎ ওই বিষয়ে বিশদে মন্তব্য করতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘‘রায় ঘোষণা করা হোক। দেখা যাক, কী হয়।’’ আর সোমবার রায় ঘোষণার পর অভিজিৎ বলেন, ‘‘যাঁরা যোগ্য প্রার্থী, তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তাঁদের ঠকিয়েছেন এই মিথ্যাচারী মুখ্যমন্ত্রী। ওঁকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে।’’
২০১৮ সালে বিচারপতি হিসাবে কর্মজীবন শুরু অভিজিতের। ২০২১ সালে তাঁর কাছে এসএসসি মামলা যায়। স্কুলে গ্ৰুপ-ডি বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর চাকরি না পেয়ে হাই কোর্টে মামলা করেন সন্দীপ প্রসাদ নামে এক চাকরিপ্রার্থী। তাঁর মামলার শুনানিতেই প্রথম ‘দুর্নীতির গন্ধ’ পান অভিজিৎ। ওই বছর শুনানি শুরু হয় ৮ নভেম্বর। ২২ নভেম্বর প্রথম সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আসে। অর্থাৎ, মাত্র ১০ দিনের মাথায় জীবনের প্রথম সিবিআইয়ের তদন্তের নির্দেশ দেন তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ছ’মাসের ব্যবধানে আরও সাতটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। তার মধ্যে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে রয়েছে চারটি। ২০২২ সালের ১৭ মে এসএসসি মামলায় অভিজিৎ শেষ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। তাঁর কথায়, ‘‘মুড়ি-মুড়কির মতো দুর্নীতি হওয়ার কারণেই মুড়ি-মুড়কির মতো সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে হয়েছে।’’
সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েই থেমে থাকেননি অভিজিৎ। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে তদন্তের পথও বাতলে দেন তিনি। লক্ষ্মী তুঙ্গার গ্ৰুপ-ডি মামলায় রাত ১২টার মধ্যে দুর্নীতির ‘কিংপিন’ এসএসসির উপদেষ্টা কমিটির প্রধান শান্তিপ্রসাদ সিন্হাকে তলব করতে সিবিআইকে নির্দেশ দেন অভিজিৎ। আব্দুল গনি আনসারির নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ মামলায় তাঁর নির্দেশ ছিল, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সিবিআই দফতরে বিকেল সাড়ে ৫টার মধ্যে হাজিরা দিতে হবে। পার্থ এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হতে পারবেন না। ওই মামলায় ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক নির্দেশ দিতেও ছাড়েননি অভিজিৎ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডিভিশন বেঞ্চ বার বার তাঁর হাত বেঁধে দিচ্ছে বলে অভিযোগও করেন সুপ্রিম কোর্টে। সেই ঘটনার পরে অভিজিতের একক বেঞ্চের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করা দুঃসহ হয়ে উঠেছিল নিয়োগ দুর্নীতির অভিযুক্তদের পক্ষে। হাই কোর্টের এক বেঞ্চ থেকে অন্য বেঞ্চে দৌড়ে বেড়িয়েছেন পার্থsরা। কোথাও সুরাহা মেলেনি। হাই কোর্টের চারটি ডিভিশন বেঞ্চ অভিজিতের নির্দেশের বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য শুনতে চায়নি।
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে তৎকালীন মন্ত্রী পরেশচন্দ্র অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কন্যাকে নিয়ে রাত ৮টার মধ্যে পরেশকে সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে বলেন অভিজিৎ। তৎকালীন বিচারপতির নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারেননি মন্ত্রী। কন্যাকে নিয়ে রাতেই কলকাতার উদ্দেশে রওনা হন। যদিও ওই দিন গভীর রাতে বর্ধমান থেকে তিনি উধাও হয়ে যান। ওই দিন আর সময়ে পৌঁছতে পারেননি সিবিআই দফতরে। তবে হুকুম মেনে পর দিন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দফতরে যান পরেশ-অঙ্কিতা। অভিজিতের সুপারিশে মন্ত্রিত্ব যায় পরেশের। চাকরি যায় তাঁর কন্যারও। কর্মজীবনের উপার্জিত অর্থ ফেরত দিতে হয় অঙ্কিতাকে। নিয়োগ দুর্নীতির ওই মামলাতেই রাত ১১টায় হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির অনুমতি আদায় করে মাঝরাতে কোর্ট বসিয়েছিলেন অভিজিৎ। নির্দেশ দিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে রাতের মধ্যেই এসএসসি দফতর ঘিরে ফেলতে হবে। অভিজিতের নির্দেশের ফলে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শান্তিপ্রসাদ সিন্হা, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক সাহা-সহ শিক্ষা দফতরের একাধিক আধিকারিক গ্রেফতার হন। আবার তাঁর বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাত’-এর অভিযোগে তাঁর এজলাস বয়কট করেন তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের একাংশ। প্রাক্তন বিচারপতি অবশ্য সরাসরি বলেছিলেন, ‘‘মাথায় বন্দুক ঠেকালেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলব। আমাকে দমানো যাবে না।’’
অভিজিতের নির্দেশে বিতর্কিত চাকরিপ্রাপকদের উত্তরপত্র (ওএমআর শিট) জনসমক্ষে প্রকাশ করে এসএসসি। সেখানে দেখা যায়, কেউ ‘শূন্য’ পেয়ে চাকরি করছেন। কেউ আবার সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে— এমন প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে কমবেশি প্রায় পাঁচ হাজার জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন অভিজিৎ। তাঁর বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতদের বক্তব্য না শোনার অভিযোগ ওঠে। স্বাভাবিক ন্যায়বিচার থেকে তিনি ‘বঞ্চিত’ করছেন বলেও অনেকে দাবি করেন। অভিজিৎ আইন জানেন না বলে সরব হন আইনজীবীদের একাংশও। যদিও অভিজিৎ বলেছিলেন, ‘‘সাদা চোখে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার দিতে গিয়ে সময় নষ্ট না করাই ভাল।’’
এসএসসি মামলায় অভিজিতের নির্দেশকে বার বার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। হাই কোর্টে হয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল মামলা। সিবিআই তদন্ত চললেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয় শীর্ষ আদালত। তখন ঘনিষ্ঠমহলে চাকরিচ্যুতদের এক আইনজীবীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ঠিক জায়গায় ধরেছেন। অনেকে বেআইনি ভাবে চাকরি পেয়েছে, এটা তো সত্যি! শুধু একটি জায়গায় সুপ্রিম কোর্টে আমরা ওঁকে কাত করতে পেরেছি— উনি বিপরীত পক্ষের বক্তব্য না শুনেই চাকরি খেয়ে নিচ্ছেন। খুব বেশি তাড়াহুড়ো করছেন।’’
চাকরিপ্রার্থীদের ঘিরে অভিজিতের এমন সব নির্দেশ ও পদক্ষেপ তাঁকে বিখ্যাত করেছিল। আইনি মারপ্যাঁচের হাজার কাঁটাছেঁড়া সত্ত্বেও আলোচনা উঠে আসে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম। একশ্রেণির মানুষের মধ্যে তাঁর প্রতি ভরসা তৈরি হয়। আশায় বুক বাঁধেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদের কাছে ‘নায়ক’ হয়ে ওঠেন অভিজিৎ। কিন্তু মাঝপথে বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তাঁর রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছে তাঁকে তাঁর উচ্চাসন থেকে নামিয়ে দেয়। ‘বিচারপতি’ থেকে তিনি ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে ওঠায় অনেকেই হতাশ। কারণ, আচমকা পট পরিবর্তনে ওই সব মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যায়। তাঁর আগের নির্দেশগুলি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেই সব নির্দেশের পিছনে কোনও ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’ ছিল কি না, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। তবে অভিজিতের কথায়, ওই সব মামলায় তাঁর আর কিছুই করার ছিল না। মামলাগুলির ‘রস্টার’ অন্য বিচারপতির কাছে চলে গিয়েছে। হাই কোর্টের নিয়ম মোতাবেক তা হয়ে থাকে। আর দুর্নীতির মূল মামলাগুলি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিশেষ বেঞ্চ শুনছে।
এখন নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের রায়ের পরে অনেকে মনে করছেন, অভিজিৎ ‘দাগ’ রেখে গেলেন ঠিকই। তবে ‘বিচারপতি’ হিসাবে ওই চাকরিপ্রার্থীদের ‘লোক’ হয়ে থেকে যেতে পারলেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy