Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

নেতা-মন্ত্রীদের ভিড়ে বিঘ্ন ত্রাণেই, ক্ষুব্ধ বানভাসিরা

রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে নবান্নে রাত কাটিয়েছেন। বাছাই করা লোকজনদের নামিয়েছেন বানভাসি এলাকায় ত্রাণের কাজ পরিদর্শনে। সোমবার নিজেও গিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার হাবরাতে।

জলের তো়ড়ে ভাসল যাত্রী-বোঝাই বাস। তবে উদ্ধার করা গিয়েছে যাত্রীদের। রবিবার রাতে তারাপীঠ থেকে রামপুরহাটের পথে কবিচন্দ্রপুর মোড়ের কালভার্টের কাছে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

জলের তো়ড়ে ভাসল যাত্রী-বোঝাই বাস। তবে উদ্ধার করা গিয়েছে যাত্রীদের। রবিবার রাতে তারাপীঠ থেকে রামপুরহাটের পথে কবিচন্দ্রপুর মোড়ের কালভার্টের কাছে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৯
Share: Save:

রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে নবান্নে রাত কাটিয়েছেন। বাছাই করা লোকজনদের নামিয়েছেন বানভাসি এলাকায় ত্রাণের কাজ পরিদর্শনে। সোমবার নিজেও গিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার হাবরাতে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দাওয়াই কতটা কার্যকর হচ্ছে, সে প্রশ্ন উঠছেই। কারণ একে তো দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে যাওয়া মন্ত্রী-সান্ত্রীদের দেখভাল করতেই ব্যস্ত হয়ে উঠছে স্থানীয় প্রশাসন। ফলে ত্রাণ-বণ্টন শিকেয় উঠছে বলে অভিযোগ। তার উপরে ত্রাণের অভাবে ক্ষুব্ধ এলাকাগুলি মন্ত্রী-নেতারা এড়িয়ে যাচ্ছেন, বা শিবিরে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়লে চটে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠছে।

রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, ‘‘যাঁদের ছিদ্র দেখা অভ্যেস, তাঁরা ছিদ্রই খুঁজবেন।’’ তাঁর দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রীরা ত্রাণ-বণ্টনে নজরদারি করায় কাজটা দ্রুত হচ্ছে।

মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় এ দিন বেলা ২টো নাগাদ পৌঁছয় অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার রবীন্দ্র শিক্ষানিকেতনের ত্রাণ শিবিরে। মমতার সঙ্গে এ দিন ছিলেন বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার, হাবরার বিধায়ক তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। শ’পাঁচেক মানুষ ওই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন গত বুধবারের ঝড়ের পর থেকে। কারও মাটির বাড়ি ধসেছে। কারও ঘরের চাল উড়েছে। তার পরে টানা বৃষ্টিতে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়েছিল। তবে রবিবার থেকে বৃষ্টি ধরায় শিবিরবাসী আপাতত বাড়ি ফিরতে মুখিয়ে আছেন।

শিবিরের সামনে কয়েক জনের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘আমি হলাম পাহারাদার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জেগে আপনাদের পাশে আছি, থাকব।’’ সেখানে তখন উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক মনমীত নন্দা, পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী থেকে শুরু করে গাইঘাটা, গোপালনগর, স্বরূপনগর, বসিরহাট, হাসনাবাদের মতো বিভিন্ন ব্লকের বিভিন্ন স্তরের প্রশাসন ও পুলিশের কর্তারা হাজির। কিন্তু বিকেল সওয়া ৩টে নাগাদ মমতার কনভয় কলকাতার দিকে রওনা হতেই গাইঘাটা এলাকার এক আধিকারিককে বলতে শোনা গেল, ‘‘গোটা দিনটা এই সফর নিয়ে দৌড়ঝাঁপে কাটল। এর পরে পান থেকে চুন খসলে আবার চাবকে গাল লাল করার কথাও বলা হবে!’’

এই সূত্রেই বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি গোটা জেলা প্রশাসনকে এ দিন এক জায়গায় নিয়ে এল। ব্যাহত হল বন্যা প্রতিরোধ, ত্রাণ।’’ সিপিএমের জেলা-নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্যের টিপ্পনী, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো ডাঙায় ছিলেন। যে সব জায়গা জলমগ্ন, সে সব জায়গায় যাননি।’’

প্রশ্ন উঠেছে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কেশপুর-সবং-পিংলা এবং ঘাটালের তৃণমূল সাংসদ দেবের পাঁশকুড়া ও দাসপুর সফরকে ঘিরেও। এ দিন দাসপুরে দেবের সঙ্গে সর্বক্ষণ ছিলেন মহকুমাশাসক (ঘাটাল) রাজনবীর সিংহ কপুর, খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত। কেশপুরে সুব্রতবাবুর সঙ্গে দেখা গিয়েছে জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা, পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ, মহকুমাশাসক (ঝাড়গ্রাম) অমিতাভ দত্ত, জেলা সভাধিপতি উত্তরা সিংহকে। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের মন্তব্য, ‘‘নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ত্রাণের কাজটাই করে উঠতে পারছেন না আধিকারিকেরা। এ দিন ঘাটালে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেকেই এখনও ত্রাণ পাননি।’’


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

যদিও মন্ত্রী সুব্রতবাবুর দাবি, ‘‘মন্ত্রী জেলায় ত্রাণ-তদারকিতে গেলে ভালই হয়। কারণ, জেলা প্রশাসনের উপরে চাপ তৈরি হয়। আর দলের কর্মীরাও কাজে লেগে পড়েন।’’

বিরোধী শিবির অবশ্য এই দাবিতে নমনীয় হচ্ছে না। শাসক দলের নেতারা ত্রাণবণ্টন ঘিরে ‘অনভিপ্রেত’ পরিস্থিতি এড়াচ্ছেন বা ‘তৈরি করছেন’ বলে সরব হয়েছে তারা। দেব এ দিন পাঁশকুড়ায় গেলেও, ত্রাণের দাবিতে ওই এলাকারই রাতুলিয়া বাজারে যেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা অবরোধ করেছিলেন, সেখানে যাননি। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, ‘‘সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ায় ওই এলাকায় যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না।’’

আবার হাওড়ার আমতায় ভেটকেপাড়া প্রাথমিক স্কুলের ত্রাণ-শিবিরে যাওয়ার জন্য দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানকে নিয়ে স্পিডবোট যখন রওনা হয়, তখন হাবল ও মল্লিকপাড়ার বাসিন্দাদের একাংশ সেখানে হাজির হয়ে ত্রাণের অভাবের অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু করেন। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম হয়। শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা বিক্ষোভকারীদের বোঝান, মন্ত্রী ফিরলে তাঁর কাছে অভিযোগ জানাতে। কিন্তু মন্ত্রী ফিরতেই তাঁকে ঘিরে রেখে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। মন্ত্রী পরে বলেন, ‘‘তেমন কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়নি। যদি কারও কোনও বিশেষ অভিযোগ থাকে, তিনি যেন প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেন।’’

প্রশ্ন উঠেছে বীরভূমের লাভপুরে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সফর নিয়েও। সেখানকার থিবা গ্রামে মন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী, পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার-সহ জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, এলাকার বিধায়ক মনিরুল ইসলাম, এসআরডিএ-র (স্টেট রুরাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি) চেয়ারম্যান অনুব্রত মণ্ডলও ছিলেন। কিন্তু ত্রাণশিবির ছুঁয়েই চলে যান মন্ত্রী। স্থানীয় সূত্রের খবর, দুর্গতদের বিলি করার জন্য আনা হয়েছিল বস্তা-বস্তা চাল আর আলু। থিবা গ্রামে ঢোকার মুখেই জলে ডুবে যাওয়া কাঁদরকুলো গ্রামে বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য আনা হয়েছিল স্পিড বোটও। কিন্তু মন্ত্রী চলে যেতেই যৎসামান্য বিলির পরে বস্তাবন্দি করে ত্রাণসামগ্রী ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তুলে নেওয়া হয় স্পিড বোটও। মন্ত্রী অবশ্য দাবি করেন, ‘‘ত্রাণ নিয়ে দুর্গতেরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।’’

ফিরহাদের কাছেই ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ জানাতে গিয়ে পাল্টা উত্তেজনার মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে মুর্শিদাবাদের বড়ঞার রসোড়া এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের। মন্ত্রী বীরভূম হয়ে গিয়েছিলেন রসোড়ার ত্রাণ-শিবিরে। সেখানে ত্রাণ বিলি করে ফেরার পথে গাড়িতে ওঠার সময় জনতার একাংশ মন্ত্রীকে বলেন, ‘‘আমরা কিছু পাচ্ছি না। একটু দেখুন।’’ ফিরহাদকে আঙুল উঁচিয়ে বলতে শোনা যায়, ‘‘ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি করবেন না। প্রয়োজনে ত্রাণশিবিরে আসুন।’’

এমনই সব উদাহরণ তুলে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘মন্ত্রীরা ছবি তুলতে আর সংবাদমাধমে নাম তুলতে ব্যস্ত। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খবর গেল কি না, এটাই মন্ত্রীদের প্রধান চিন্তা, ত্রাণ নয়।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহর অভিযোগ, ‘‘মন্ত্রীরা দৌড়ে বেড়ালে পুলিশ-প্রশাসন তাঁদের ত্রাণেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া আবার জোর দিয়ে বলছেন, ‘‘ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি, বিডিও, এসডিও, জেলাশাসকের মধ্যে সমন্বয় রেখে সর্বদলীয় কমিটি গড়া হলে ত্রাণ বণ্টনে সুবিধে হতো।’’

তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগ বা দাবিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, বন্যা পরিস্থিতিতে দুর্গতদের একটা বড় অংশ মানসিক ভাবে অতি সংবেদনশীল হয়ে রয়েছেন। ফলে, তাঁদের তরফে উত্তেজনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। আর বিরোধীরা সেই সূত্রে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে উস্কানি দিচ্ছেন। খোদ মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন অশোকনগরে বলেছেন, ‘‘শুধু গালাগাল দিলেই হবে? বিরোধী দলের শুভবুদ্ধি হোক। আপনারা ভাল থাকুন। আর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের গালাগাল করুন।’’

তাঁর সংযোজন, ‘‘যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়, তখন রাজনীতি করতে নেই। মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে, ঘরবাড়ি ভেঙে গিয়েছে। আমি মানুষের কাছে যাব, না টিভিতে মুখ দেখাব?’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE