ঠিক সিনেমায় যেমন হয়!
বৃহস্পতিবার ভরসন্ধ্যায় মধ্যমগ্রাম উড়ালপুলের কাছে ভিড়ে ঠাসা এলাকা এমনই ঘটনার সাক্ষী থাকল। উড়ালপুলের উপরে একটি গাড়িকে ঘিরে ধরে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে গাড়ির আরোহী দুই ব্যক্তিকে খুন করল বাইকে চেপে আসা এক দল দুষ্কৃতী। গাড়ির আর এক আরোহী দেহে চারটি গুলি নিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। গাড়ির চালকের দেহের নানা জায়গায় কাচের টুকরো ঢুকে গেলেও তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, গাড়িটি চালাচ্ছিলেন জগদীশ সরকার নামে এক ব্যক্তি। দুষ্কৃতীদের গুলিবৃষ্টির মধ্যেই তিনি প্রচণ্ড গতিতে গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যান পাঁচ কিলোমিটার দূরের পানিহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। দুষ্কৃতীরা বাইক নিয়ে গুলি চালাতে চালাতে তাঁদের গাড়িটিকে কিছুক্ষণ ধাওয়া করলেও শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায়।
ভরসন্ধ্যায় এমন ঘটনার জেরে তুমুল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে উড়ালপুল চত্বরে। মৃতদের পরিচয় জানার পরে পুলিশের প্রাথমিক অনুমান যে, জমি-বাড়ি বিক্রির ব্যবসা নিয়ে রেষারেষির জেরেই এই ঘটনা ঘটেছে। গাড়িতে চালক-সহ যে চার জন ছিলেন, তাঁদের অন্যতম তারক সেন ওরফে বাবু (৫১)-ই দুষ্কৃতীদের মূল লক্ষ্য ছিলেন বলে প্রাথমিক ধারণা পুলিশের। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গাড়িতে বাবু বসেছিলেন সামনে, চালকের পাশে। বাবুর ঠিক পিছনের আসনে বসেছিলেন তাঁর ছায়াসঙ্গী নিতাই পাল ওরফে নুঙ্কাই (৩২)। বাবুর মতো তাঁর শরীরও গুলিতে ঝাঁঝরা
হয়ে গিয়েছে বলে পানিহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতাল সূত্রের খবর। বাবু এবং নুঙ্কাইয়ের হেফাজত থেকে দুটি রিভলভার মিলেছে বলে পানিহাটি হাসপাতাল সূত্রের খবর। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, ঘটনাস্থলে সব মিলিয়ে অন্তত ২০ রাউন্ড গুলি চলেছে। পুলিশ জানিয়েছে, গাড়ির চালক জগদীশবাবু সম্পর্কে বাবু সেনের ভগ্নিপতি। পুলিশ তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে।
কে এই বাবু সেন?
পুলিশের বক্তব্য, বাবু আগে থাকতেন বেলঘরিয়ার দেশপ্রিয়নগরে। এখন থাকেন আগরপাড়ার উসুমপুর এলাকায়। বাবু এমনিতে জমির দালালি করেন। এলাকায় তিনি ‘মাটি বাবু’ বলে পরিচিত। পুলিশ জানাচ্ছে, ২০১৩ সালের ১৫ অগস্ট উসুমপুরের গাঙ্গুলিবাগান এলাকায় জমি সংক্রান্ত বিবাদের জেরে খুন হন সুরজিৎ চক্রবর্তী এবং পার্থ দাস নামে দু’জন। সেই ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন বাবু সেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারও করেছিল। কয়েক দিন আগেই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন বাবু। পুলিশের অনুমান, ২০১৩ সালের ওই খুনের বদলা নিতেই এ দিন পরিকল্পনা করে বাবুর উপরে হামলা চালানো হয়। এবং এ ধরনের হামলা যে হতে পারে, সে সম্পর্কে বাবু নিশ্চিত ছিলেন বলেই অনুমান তদন্তকারীদের। তাই সব সময়েই তিনি সশস্ত্র থাকতেন।
যে মারুতি গাড়িতে চেপে বাবু সেন যাচ্ছিলেন, সেই গাড়ির একেবারে সামনে চালকের মাথার কাছে থাকা আয়নায় ঝোলানো রয়েছে তৃণমূলের স্বেচ্ছাসেবকের একটি বড় ব্যাজ।
এটি দেখে পুলিশের অনুমান, বাবু জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষ অবশ্য বলেন, ‘‘পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই গাড়ির সামনে তৃণমূলের ব্যাজ ঝুলিয়ে রাখছে। তৃণমূলের ব্যাজ যেন এখন গাড়ির পারমিট!’’
এ দিন ঠিক কী হয়েছিল?
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা তখন সাতটা। মধ্যমগ্রাম রেল স্টেশনের দিক থেকে উড়ালপুলের নীচ দিয়ে এসে বাঁক নিয়ে সেতুর উপরে উঠছিল বাবুদের মারুতি গাড়িটি। উড়ালপুলের মুখে গাড়িটি পশ্চিমে সোদপুরের দিকে ঘুরতেই সামনে এসে দাঁড়ায় একটি স্করপিও গাড়ি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, স্করপিওটি থেকে নেমে আসে কয়েক জন যুবক। ইতিমধ্যে আশপাশ থেকে কয়েকটি মোটর বাইক এসে ঘিরে ধরে বাবুদের গাড়িটিকে। তার পরেই শুরু হয় গুলিবৃষ্টি। ঝনঝন করে ভেঙে যায় বাবুদের গাড়ির সবক’টি কাচ। গাড়ির সামনের আসনে চালকের পাশেই বসেছিলেন বাবু। তাঁর পিছনেই ছিলেন নুঙ্কাই। তদন্তকারীদের বক্তব্য, ঘটনাস্থল এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান থেকে জানা গিয়েছে, বাবু-নুঙ্কাইরা যে দিকে বসেছিলেন, সে দিক থেকেই গুলিবৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, এ থেকে স্পষ্ট, বাবুই ছিলেন দুষ্কৃতীদের মূল নিশানা।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তার মধ্যেই গুলিবৃষ্টি শেষ করে স্করপিওতে চড়ে উধাও হয়ে যায় কয়েক জন দুষ্কৃতী। কিন্তু হামলা তখনও শেষ হয়নি। সামান্য সুযোগ পেয়ে মারুতির চালক তত ক্ষণে গাড়ি ছুটিয়েছেন সোদপুরের দিকে। গুলি চালাতে চালাতে তাদের পিছনে ধাওয়া করে বাইকে চড়া কয়েক জন।
স্টেশন সংলগ্ন এলাকাটিতে রয়েছে দোকান বাজার। গুলিবৃষ্টির সময়েই কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন এক সরকারি কর্মচারী। তিনি বলেন, ‘‘সন্ধ্যার এই সময়টায় মধ্যমগ্রামের এই এলাকা ভিড়ে ঠাসা থাকে। এমন ঘটনা আগে কখনও দেখিনি। আমার তো বলিউড ফিল্ম ‘গ্যাঙস অফ ওয়াসিরপুর’-এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল!’’
ঘটনাস্থলের কাছেই স্টেশনারি দোকানের মালিক সুজয় বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রথমে মনে করছিলাম পটকা ফাটছে। পরে দেখলাম গুলি চলছে! ভাল করেই বোঝার আগেই পুরো দৃশ্যটা শেষ হয়ে গেল! শুধু দেখলাম, গাড়ির চালক স্টিয়ারিংয়ের নীচে মাথা গুঁজে বাঁচার চেষ্টা করছে।’’ গুলিবৃষ্টি থামার পরে কী দেখলেন? তিনি বলেন, ‘‘দেখলাম, ঘটনাস্থল কার্তুজের খোলে ভরে গিয়েছে। এক জন ওই খোলগুলিকে তুলে নিয়ে বাইকে চেপে পালিয়ে গেল!’’ আর এক দোকানদারের বয়ান, ‘‘স্করপিও থেকে নেমে জিনস পরা ঢ্যাঙা এক যুবকই প্রথম গুলিটা চালায়। তার পরে অন্যরা গুলি চালাতে শুরু করে।’’
হামলাকারীরা ঠিক কত জন ছিল?
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, চোখের নিমেষে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় তাঁরা এ সব ব্যাপার বুঝেই উঠতে পারেননি। কেউ বলছেন, স্করপিও থেকে কয়েক জন নেমে এসেছিল। তাদের কেউ কেউ একটি বিরিয়ানি দোকানের কাছে অপেক্ষা করছিল। তার মধ্যেই এলাকায় আসে কয়েকটি বাইক। তাতেও কয়েক জন যুবক বসেছিল। গুলিবৃষ্টির সময় ওই স্করপিও গাড়িটিই বাবুদের গাড়ি আটকে দাঁড়ায়। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা নিয়ে বিভ্রান্তি কিছুটা রয়েই গিয়েছে। তবে পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, সংখ্যাটা কমবেশি সাত-আট জন। ‘অপারেশন’ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে স্করপিওটি চলে যায় বারাসতের দিকে।
রীতিমতো ছক কষেই এ দিনের এই হামলা, ধারণা পুলিশের। জগদীশ বলেন, ‘‘বাবু, নুঙ্কাইকে নিয়ে আমরা দুপুর ১২টা নাগাদ মধ্যমগ্রামের খালের পাড়ে একটি বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে জমিজায়গা নিয়ে বাবুদের কথাবার্তা হয়। সন্ধ্যাবেলা সেখান থেকেই আমরা সোদপুরের দিকে ফিরছিলাম। পথে এই হামলা।’’
প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীরা মনে করছেন, বাবুদের গতিবিধি আগে থেকেই জানত দুষ্কৃতীরা।
তাই তারা এমন একটা জায়গায় হামলার ছক নেয়, যেখানে বাবুদের গাড়িকে উড়ালপুলে ওঠার মুখে গতি কমাতেই হতো। কারণ সেখানে একটি বাম্পার রয়েছে। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটে যায় যে, সঙ্গে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি বাবুরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy