ফরজানা আলম।
প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলমের অকাল মৃত্যুর পরেই তৃণমূল নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল তাঁর পরিবার। শনিবার শেষকৃত্যের দিনে রাজ্য সরকার এবং শাসক দলকে কার্যত বয়কটই করলেন তাঁরা। তপসিয়ার তৃণমূল ভবন তো দূরের কথা, পুরভবনেও আনা হল না ফরজানার দেহ! বিস্তর ‘চাপ’ সত্ত্বেও।
পিস হেভ্ন থেকে দেহ বার করে শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় ফরজানার বড়দা খুরশিদ আলম বলেন, ‘‘বোনের দেহ পুরসভায় নিয়ে যেতে বার বার চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি।’’ কেন রাজি হননি, তা প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়ে খুরশিদ বলেন, ‘‘ফরজানার প্রতি যে অবিচার হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর সরব হওয়া উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি। তৃণমূল অফিসে তাঁকে মারধরের পরে উচিত ছিল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’’ ফরজানার মৃত্যুর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে কোনও শোকবার্তা না-আসাও যে তাঁদের উষ্মার অন্যতম কারণ, তা-ও বুঝিয়ে দিয়ে খুরশিদের মন্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বারও ফরজানাকে দেখতে এলেন না। তাঁর একটা ফোনও এল না!’’ অন্য আত্মীয়দেরও প্রশ্ন, ফরজানার ১২ বছরের ছেলেকেও কেন সমবেদনা জানাতে এলেন না মুখ্যমন্ত্রী বা মেয়র? এ দিন ফরজানার শেষযাত্রায় যোগ দিতে এসে ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী বলেন, ‘‘প্রয়োজন মতো ফরজানাকে ব্যবহার করেছে তৃণমূল। মৃত্যুর পরে এক বার তাঁকে দেখতে আসতেও পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী!’’
এই সমালোচনার মুখে অস্বস্তি চাপা থাকছে না শাসক দলের অন্দরের আলোচনাতেও। দলের একাংশের বক্তব্য, ২৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে গত বার পুরভোটে জেতার পরে ফরজানা ডেপুটি মেয়র হয়েছিলেন মূলত কুণাল ঘোষের সুপারিশে। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারির আবহে তৃণমূলে যত কোণঠাসা হয়েছেন কুণাল, পাল্লা দিয়ে হাল খারাপ হয়েছে ফরজানারও।
এ বারের পুরভোটে ফরজানাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্যই তাঁকে সরিয়ে ৬৫ নম্বরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য। ৬২, ৬৩ বা ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জিতলেও হেরেযান ফরজানা! দলের একাংশের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতা’র অভিযোগ তুলে দলনেত্রীর বাড়িতে নালিশ জানাতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মমতার দেখা না-পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসেন। এর পরেই ৩০ এপ্রিল পাম অ্যাভিনিউয়ে দলের কার্যালয়ে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা মাখনলাল দাসের লোকজনের হাতে ফরজানা আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ।
অসুস্থ ফরজানা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গত সোমবার। যে হেতু মারধরের ঘটনার পরেই তাঁর মৃত্যু, তাই পুরো বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে বিরোধীরা। খুরশিদও মঙ্গলবার অভিযোগ করেন, তৃণমূলই ফরজানার জীবন শেষ করে দিয়েছে।
ফরজানার পরিবারের ক্ষোভ যে বিড়ম্বনা ডেকে আনতে চলেছে, তার আন্দাজ পেয়ে তৎপর হয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তাঁর মরদেহ পুরভবনে এনে সম্মান জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পুরসভার পক্ষ থেকে। কিন্তু সেই উদ্যোগে বাধ সাধে ফরজানার পরিবার। মরদেহ পুরসভায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব এক রকম প্রত্যাখান করেই ‘পিস হেভ্ন’থেকে এক আত্মীয়ের বাড়ি ও মসজিদ হয়ে বাগমারি কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। শাসক দলেরই একাংশের বক্তব্য, শুধু পুরসভা বা তৃণমূল ভবনে দেহ নিয়ে যেতে অস্বীকার করেই নয়, মরদেহ পুরসভার তৈরি শব সংরক্ষণাগারে না-রেখেও আসলে তৃণমূলের ‘অনাদরের’ জবাব দিতে চেয়েছে ফরজানার পরিবার।
প্রাক্তন ডেপুটি মেয়রের প্রতি তৃণমূলের অনাদরকে হাতিয়ার করছেন অন্যেরাও। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন, ‘‘তৃণমূল শুধু সংখ্যালঘু মানুষের সঙ্গে বঞ্চনা করেনি, প্রতারণাও করেছে। ফরজানার ঘটনা তার জ্বলন্ত উদাহরণ!’’ সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘ফরজানাই বুঝিয়ে দিলেন, দলনেত্রীর অপছন্দ হলে তৃণমূলে থেকেও কারও শান্তি নেই!’’
এ দিন ফরজানার শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, দমকল মন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খান এবং তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পাল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বা মেয়র এলেন না কেন? ডেপুটি মেয়র তথা তৃণমূল নেতা ইকবাল আহমেদ এ দিন দুপুরে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী শহরের বাইরে রয়েছেন।’’ তৃণমূলের একাংশ কিন্তু জানাচ্ছে, পুরুলিয়া-বাঁকুড়া সফর সেরে এ দিন বেলা চারটে নাগাদই নবান্নে ঢুকে যান মুখ্যমন্ত্রী। ফরজানার শেষকৃত্য হয় সন্ধ্যা ৬টার পরে। আর মেয়র সারা দিন পুরসভাতেই ছিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy