কৃতী: বাবা আবুল আল মামুনের সঙ্গে কোহিনুর। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়
বাবা কৃষক। দেড় বিঘা জমি চাষ করে চলে সংসার। কার্যতই নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়ার অবস্থা পরিবারের। সেই পরিবারের মেয়ে এ বারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৫০০ নম্বরের মধ্যে ৪৮১ পেয়েছেন। এক বছর প্রস্তুতি নিয়ে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে চান তিনি। তা শুনেই ঘুম ছুটেছে বাবা-মায়ের।
দেগঙ্গার উত্তর আমুলিয়ার বাসিন্দা আবুল আল মামুন পেশায় চাষি। নিজের জমিতে ফসল ফলিয়ে তা বিক্রি করে কোনও মতে সংসার চালান আবুল। তার মধ্যেই সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বড় মেয়ে কোহিনুর নাহার সবাইকে অবাক করে দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৮১ নম্বর পেয়ে স্বপ্ন দেখছেন অনার্স নিয়ে পড়ার পাশাপাশি ডাক্তারি পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নেবেন। আর তা নিয়েই চিন্তায় পড়েছেন আবুল ও তাঁর স্ত্রী। মেয়েকে ডাক্তারির পরীক্ষায় বসানোর প্রস্তুতির খরচ কোথা থেকে আসবে, তা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে বাবা-মায়ের। মুখ গোমড়া কোহিনুরেরও।
কোহিনুর এ বার ইংরেজি ও জীববিদ্যায় ৯৫ এবং গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় ৯৭ করে পেয়েছেন। স্কুলে বরাবরই প্রথম স্থান পেতেন কোহিনুর। দেগঙ্গার সুবর্ণপুর হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিকে পাঁচটি লেটার-সহ ৮৮ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন তিনি।
এর পরে হাড়োয়ার আল মুস্তফা নামে একটি আবাসিক মিশন থেকে মেয়েটির পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়। সেই মিশন কর্তৃপক্ষের সাহায্যে বসিরহাটের ঝুরুলি আদর্শ বিদ্যাপীঠ থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেন কোহিনুর। সুবর্ণপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সোনালি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘খুব মেধাবী ছাত্রী কোহিনুর। কত কষ্ট করে পড়াশোনা করে। কিন্তু চেষ্টা থাকলে যে ভাল ফল করা যায় কোহিনুর তার উদাহরণ। বিশ্বাস করি, ও চাইলে ডাক্তার হতেও পারবে।’’
কিন্তু কী করে হবে স্বপ্নপূরণ?
কোহিনুরের বাবা আবুল জানান, দুই মেয়ে এবং এক ছেলের মধ্যে কোহিনুরই সবার বড়। তাঁর কথায়, ‘‘চাষ করে কোনও মতে পাঁচ জনের খাবার জোটে। জানি মেয়ে পড়াশোনায় ভাল। জেদ যখন করেছে, সুযোগ পেলে ডাক্তারও হয়ে দেখাবে। কিন্তু গরিব বাবার সেই সামর্থ্য কোথায়!’’
কোহিনুরের মা মাসুরা বিবি বলেন, ‘‘আমি ও আমার স্বামী দু’জনেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। চেয়েছিলাম, মেয়ে কলেজে পড়ে স্নাতক হয়ে চাকরি করবে। কিন্তু মেয়ে এখন চাইছে ডাক্তার হতে। মেডিক্যাল পরীক্ষায় বসতে।’’ মা আরও বলেন, ‘‘জানি ডাক্তারি পড়াতে গেলে কোচিংয়ে ভর্তি, বইপত্র কেনা-সহ বিভিন্ন খাতে প্রচুর খরচ লাগে। আমাদের অত টাকা কোথায়? ওই জমিটুকু ছাড়া তো কিছুই আমাদের নেই। জমি বিক্রি করলে বাচ্চারা খাবে কী!’’
ইটের দেওয়ালের উপরে টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট ঘর কোহিনুরদের। ঘরে আসবাব বলতে একটা তক্তপোষ, তার উপরে ঠাসা তিন ভাইবোনের বই, খাতা। জমিতে এ বার বেশ কাঁকরোল ফলেছে। শুক্রবার মাঠে কাঁকরোল তুলছিলেন আবুল আল মামুন। বাবার জন্য পান্তাভাত নিয়ে দুপুরে মাঠে গিয়েছিলেন কোহিনুর। ভাল ফলের পরেও মুখে হাসি নেই বাবা-মেয়ের।
কেন ডাক্তার হতেই হবে?
মাঠে বসে বাবাকে জল দিতে দিতে কোহিনুর জানান, এই সব এলাকার বেশির ভাগ মানুষ ছোট চাষি, খুব গরিব। গত তিন বছরে বহু মানুষ টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে অজানা জ্বর আর ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছেন। এখন করোনার প্রকোপে এলাকার পরিস্থিতি আরও খারাপ। চিকিৎসক নেই। কোহিনুর বলেন, ‘‘তাই কলেজে পড়ে স্নাতক নয়, ডাক্তার হতে চাই। এক বার যদি কোচিং নিয়ে মেডিক্যালে বসতে পারি....।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy