Advertisement
E-Paper

এনআরএস ছাত্র হস্টেলে পিটিয়ে মারা হয় ১০ বছর আগে! কোরপানের বাড়িতে আনন্দবাজার অনলাইন

২০১৪ সালে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে কোরপান শাহকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। বৌবাজারকাণ্ডের পর থেকে কোরপানের স্ত্রীর মনে একটাই প্রশ্ন, নিহতের স্ত্রী লড়াই করতে পারবেন তো!

ছোট ছেলের সঙ্গে অন্ধকার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আরজিনা বেগম।

ছোট ছেলের সঙ্গে অন্ধকার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আরজিনা বেগম। — নিজস্ব চিত্র।

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪ ১৭:১৭
Share
Save

তিনি পেরেছেন! গত ১০ বছর ধরে নিজের মতো করেই পেরেছেন! কিন্তু কঠিন সেই লড়াইটা কি দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে লড়তে পারবেন বৌবাজারের গণপিটুনিতে নিহত ইরশাদ আলমের স্ত্রী? প্রশ্ন তুললেন কোরপান শাহের স্ত্রী আরজিনা বেগম। ২০১৪ সালে নীলরতন সরকার (এনআরএস) মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে মারধর করে কোরপানকে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ, শুক্রবার ইরশাদেরও মৃত্যু প্রায় একই ভাবে গণপ্রহারে হয়েছে। ইরশাদের মৃত্যুর কথা আরজিনা জেনেছেন শনিবার সকালে। শোনার পর থেকেই তাঁর মাথায় ঘুরে চলেছে একটাই প্রশ্ন। তিনি পেরেছেন। ইরশাদের স্ত্রী সালমা বিবি তাঁর মতো লড়াই করতে পারবেন তো? নানা কথার মধ্যে বার বার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে চললেন, ‘‘কেউ কথা রাখে না। কেউ খবর রাখে না।’’

আরজিনার পাঁচ সন্তান। তিন ছেলে আর দুই মেয়ে। দুই মেয়ে টুম্পা খাতুন আর ঝুম্পা খাতুন। বড় জনের ১৪। আর ছোট মেয়ের বয়স মাত্র ১২। হাওড়ার উলুবেড়িয়ার ফকিরপাড়ায় রাস্তার ধারেই আরজিনাদের বাড়ি। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়েছে। ঘরে বসে আরজিনা বলছিলেন, ‘‘এই বয়সি মেয়েদের একা ঘরে রাখব কী করে? লোকে বদনাম দেবে। তাই ওদের মাদ্রাসায় পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছি।’’

দুই মেয়ের জন্য মাসে ২,৪০০ টাকা দিতে হয়। মাসে দু’বার দেখা করতে যান আরজিনা। তখন মেয়েদের জন্য শুকনো খাবার, চানাচুর, ফল নিয়ে যান। তাতেও খরচ পড়ে অন্তত ৫০০ টাকা। তাঁকে ধরে বাড়িতে চালাতে হয় সব মিলিয়ে চারটে পেট। হিমশিম খান আরজিনা। তিনি বলছিলেন, ‘‘ওঁর (কোরপান) মৃত্যুর পর অনেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সরকারি চাকরি দেওয়ার কথাও বলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু ১০ বছর কেটে গিয়েছে। কেউ কথা রাখেনি।’’

লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য আবেদন করেছিলেন আরজিনা। শেষ পর্যন্ত পাননি। তিন ছেলের মধ্যে বড় আজহারউদ্দিন শাহের বয়স ২০। তার পরের জন মুজিবর শাহের বয়স ১৮। দু’জনেই পুরনো শিশি-বোতল কুড়িয়ে আনার কাজ করেন। ওই কাজ করে দিনে ৫০-৬০ টাকা পান। কখনও মায়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন। কখনও উল্টে মায়ের থেকেই টাকা চান। ওই দু’জনকে আর পড়াশোনা করানো হয়নি। ছোট ছেলের বয়স ১০ বছর। সে স্কুলে পড়াশোনা করে।

দুই ছেলের সঙ্গে আরজিনা বেগম।

দুই ছেলের সঙ্গে আরজিনা বেগম। — নিজস্ব চিত্র।

প্রথমে ভিক্ষা করতেন আরজিনা। সঙ্গে নিতেন নিজের মাকে। তার পর লোকের বাড়ি কাজ নেন। ঘরে পাঁচ সন্তান। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। তাঁর পরিবারের এই অবস্থা জেনেও কাজের বাড়ির মালিকেরা ঠিকঠাক মাইনে দিতেন না। কাজ ছেড়ে দেন। নাইটির ব্যবসা করবেন বলে অতিমারির আগে ২৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেই শুরু হয় লকডাউন। সেই সময় খেতেই চলে যেত সব টাকা।

অগত্যা নার্সিং হোমে আয়ার কাজ নিয়েছিলেন আরজিনা। রোগীদের মল-মূত্র সাফ করতেন। মাস গেলে ২,০০০ টাকা পেতেন। তার পর সব্জির ব্যবসা শুরু করলেন। রোজ ভোর থাকতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন আরজিনা। উলুবেড়িয়া স্টেশনে গিয়ে সব্জি কেনেন। বাড়ি থেকে ডিম, নারকেল নিয়ে যান। তার পর টিকিয়াপাড়া হয়ে যান বেলুড়ে। সেখানে বাজারে বিক্রি করেন সব্জি। বিকেল নাগাদ বাড়িতে ফিরে আসেন। তার পর রান্না করেন। পান্তা করে রেখে দেন ভাত। পরের দিন ছেলেরা সেই ভাতই খায় সারা দিন। আরজিনা এখন আর রোজ কাজে যেতে পারেন না। রক্তচাপ অসম্ভব কম। সেই শরীরে ৫০-৬০ কেজি ওজনের সব্জির বস্তা নিয়ে রোজ বেলুড়ে গিয়ে বাজারে বসতে পারেন না তিনি। অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই পড়ে থাকেন।

কলকাতার রাস্তায় ভিক্ষা করতেন কোরপান। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর আর বাড়ি ফেরেননি। পরের দিন এনআরএসের ছাত্রাবাস থেকে উদ্ধার হয় তাঁর দেহ। ‘‘বাড়িতে তখন চার ছেলেমেয়ে আর অন্তঃসত্ত্বা আমি। উনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ভিক্ষা করে সংসার চালাতেন। তবু তো মাথার উপর ছাদ হয়ে ছিলেন। অভিভাবক ছিলেন,’’— একনাগাড়ে বলে চলেন আরজিনা।

কোরপানের মৃত্যুর পর এ দিক-ও দিক থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। সেই টাকায় প্রথমে মাথার ‘ছাদ’টা শক্ত করে নিয়েছিলেন আরজিনা। বাড়ির ছাদ দিয়ে জল পড়ত। আরজিনা বুঝেছিলেন, ছাদ শক্ত না করলে কঠিন লড়াইয়ে নামা যাবে না। ফকিরপাড়ার জীর্ণ বাড়িটায় তাই ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করিয়েছিলেন। তার পর থেকে সেই ছাদে আর সিমেন্ট বা রঙের প্রলেপ পড়েনি। দেওয়ালেও পড়েনি কোনও রঙের প্রলেপ।

টাকার অভাবে কোরপানের মামলাটাও আর চালাতে পারেননি আরজিনা। পিটিয়ে খুনের অভিযোগে ওই ছাত্রাবাসের দুই ক্যান্টিনকর্মী এবং ১০ জন ডাক্তারি পড়ুয়ার বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করেছিল পুলিশ। ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জামিন পেয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তারির ওই পড়ুয়ারা। তার পর কী হল, আর জানেন না আরজিনা।

কলকাতায় গিয়ে মামলা চালানো আর সম্ভব হয়নি তাঁদের। শনিবার সকালে বাড়িতে বসে আরজিনা বলছিলেন, ‘‘ওঁদের (অভিযুক্তদের) কড়া শাস্তি হলে লোকে ভয় পেত। তা হলে আজ ইরশাদকে এ ভাবে মরতে হত না।’’ তার পরেই চিন্তায় ডুবে যান আরজিনা।

কখনও ঘর বাঁধার কথা ভাবেননি?

আরজিনা বলছিলেন, কোরপানের মৃত্যুর পর থেকে অনেক ‘কুপ্রস্তাব’ পেয়েছেন। পরিচিতেরাই বেশির ভাগ সময়ে ওই সব প্রস্তাব দিতেন। আরজিনার কথায়, ‘‘মেয়েরা একলা থাকলে যা হয়!’’ কিন্তু ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ওদের কি কেউ বাবার মতো ভালবাসতে পারবে? ওরা কোথায় যাবে?’’ নিজের পাশাপাশি আরজিনার ভাবনায় এখন ইরশাদের স্ত্রী, দিদি, ছেলেমেয়েরা। তাঁর কথায়, ‘‘আমি কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে বড় করছি। আবার আমার মতো কষ্ট করতে হবে আরও এক জনকে। কারণ, কেউ কথা রাখে না!’’ একটু নীরব থেকে আবার বলেন, ‘‘আমি তো পেরেছি! ইরশাদের স্ত্রী পারবেন? ওঁদের তো নিজের বাড়িও নেই! ভাড়াবাড়িতে থাকেন। কোনও কাজও করেন না। আমার তা-ও ছাদটা ছিল। ওঁদের কী হবে!’’

NRS lynch

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।