Advertisement
০১ জুলাই ২০২৪
Man Beaten to Death in Bowbazar

‘বস্তিতে থাকি, কিন্তু চোর নই, একমাত্র রোজগেরে ছেলেটাকে মেরে দিল!’ ইরশাদের দিদির বিলাপ

বেলগাছিয়ার ঘিঞ্জি বস্তি চিরে চলে গিয়েছে একচিলতে রাস্তা। দু’পাশে জীর্ণ দেওয়ালের গায়ে পর পর দরজা। কোনওটিতে ঝুলছে মলিন পর্দা। তার মধ্যে একটিতে বাস ইরশাদের পরিবারের।

এই ঘরেই থাকতেন ইরশাদ।

এই ঘরেই থাকতেন ইরশাদ। — নিজস্ব চিত্র।

সারমিন বেগম
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪ ২২:৪০
Share: Save:

ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটা পেয়ে প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেননি মদিনা বেগম। সময় যত গড়িয়েছে, ততই অনুভবে জাঁকিয়ে বসেছে, ভাই আর নেই! এখন একটাই চিন্তা খুবলে খাচ্ছে মদিনাকে, পাঁচ জনের সংসারের একমাত্র রোজগেরে ইরশাদের মৃত্যুর পর সংসার চলবে কী করে? কাল থেকে তাঁর ছেলেমেয়েগুলো খাবে কী?

শুক্রবার সকালে বৌবাজারের ছাত্রাবাসে মোবাইল চোর সন্দেহে এই ইরশাদকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে। ৩৭ বছরের যুবককে মারধরের অভিযোগে পুলিশ ১৪ জনকে শুক্রবার রাতেই গ্রেফতারও করেছে। ছাত্র বলে অভিযুক্তদের রেয়াত করতে রাজি নন ইরশাদের দিদি মদিনা। তাঁদের কড়া শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি।

বেলগাছিয়ার ঘিঞ্জি বস্তি চিরে চলে গিয়েছে এক চিলতে রাস্তা। দু’পাশে জীর্ণ দেওয়ালের গায়ে পর পর দরজা। কোনওটিতে ঝুলছে মলিন পর্দা। তার মধ্যে একটিতে বাস ইরশাদের পরিবারের। পলেস্তরা খসা বাড়ির গায়ে ঠিকানা লেখা, ‘১/৭ জীবনকৃষ্ণ রোড’।

গলি-মুখের পর্দা সরালে চোখে পড়বে ছোট গলি। তার বাঁ দিকে তিন-চারটে ঘর। প্রতিটিতে একটি করে পরিবারের বাস। গলির শেষে সোজা রয়েছে একটি দরজা। সেই দরজার পর্দা সরিয়ে ঘুরে ঢুকলেই শেষ। সবুজ রং চটে কোথাও বেরিয়ে পড়েছে নীল চুনরং। কোথাও দাঁত বার করে রয়েছে ইট। ঘরে কোনও জানলা নেই। বিছানা নেই। আলমারি নেই। মেঝেতে মাদুর পাতা। তার পাশে সার সার দিয়ে রয়েছে হাঁড়ি, কড়াই। দড়িতে কিছু জামাকাপড় শুকোচ্ছে। মেঝেতে রয়েছে সুটকেস, ব্যাগ রয়েছে। সেখানে জামাকাপড় রাখা। ওই চিলতে স্যাঁতসেঁতে ঘরে দুই সন্তান, স্ত্রী এবং দিদিকে নিয়ে বাস ছিল ইরশাদের। ঘরের ভাড়া ১০০ টাকা। মদিনার চিন্তা, সেই টাকা পরের মাসে জোগাবে কে?

স্ত্রী বাড়িতেই থাকেন। ঘরের কাজ করেন। সাত বছরের ছেলে এবং ১১ বছরের মেয়ে রয়েছে ইরশাদের। দু’জনেই পড়াশোনা করে। বকরি ইদ উপলক্ষে কাঁকিনাড়ায় দিদার বাড়িতে গিয়েছে মেয়ে এশরাদ পরভিন এবং ছেলে ওয়াকার আলম। এখনও বাড়ি ফেরেনি তারা।

রোজের মতো শুক্রবারও ভোর ৬টায় কাজে বেরিয়েছিলেন ইরশাদ। না খেয়ে। রোজের মতোই বাইরে খেয়ে নেওয়ার কথা ছিল। তার পর রোজের মতোই রাত ৯টায় কাজ সেরে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। চাঁদনি চকে একটি টিভি মেরামতির দোকানে কাজ করতেন তিনি। কাজ সেরে আর বাড়ি ফেরা হয়নি ইরশাদের। অভিযোগ, সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ বৌবাজারের ফুটপাথ থেকে চোর সন্দেহে ধরে তাঁকে ছাত্রাবাসের ভিতরে নিয়ে যান কয়েক জন। আরও অভিযোগ, তার পর ছাত্রাবাসের ভিতরে চলে মারধর। খবর পেয়ে পুলিশ এলে প্রথমে ছাত্রাবাসের দরজা খোলা হয়নি বলে খবর। পরে তাঁকে উদ্ধার করে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। বেলগাছিয়ার জীবনকৃষ্ণ রোডের বাড়িতে বসে মদিনা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘‘আমরা বস্তিতে থাকি, কিন্তু চোর নই। কাজ করে খাই।’’

বস্তিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে, বেশ কিছু বাড়িতে চলছে চটের ব্যাগ সেলাইয়ের কাজে। গোলাম হোসেন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘এখানে শান্তি কমিটি রয়েছে। ও চোর হলে আমরাই প্রতিবাদ করতাম। আজ এই ঘটনার পর ওর বাড়িতে আসতাম না।’’ মদিনার কথায়, ‘‘আমার ভাই কাজ করে, চুরি করে খাওয়ায় না।’’

চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন ইরশাদ। তার পর থেকে কাজ করতেন। কাজ করেই সংসার চালাতেন। দিদি মদিনার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর থেকে ভাইয়ের সংসারেই থাকেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল ইরশাদেরই কাঁধে। এই সংসার টানতেই মুখ বুজে কাজ করে যেতেন ইরশাদ। স্থানীয়েরা জানালেন, ওই একটাই দোষ ছিল তাঁর, বড্ড ভীরু ছিলেন তিনি। কোনও দোষ করে ফেললে কান ধরে ওঠবোস করতেন। পাড়ার অনেকেই তাই মজা করে ভয় দেখাতেন। ইরশাদ কোনও প্রতিবাদ করতে পারতেন না। তবে কোনও মানসিক সমস্যা তাঁর ছিল না, এমনটা জোর দিয়েই জানিয়েছেন প্রতিবেশী গোলাম। আর গোলাম বলছেন, ‘‘ওঁরা তো পড়াশোনা করেছেন। চুরির অভিযোগ থাকলে পুলিশের কাছে দিতে পারতেন ইরশাদকে! ও দুর্বল ছিল বলেই কি খেসারত গুনতে হল আজ?’’— প্রশ্ন তাঁর।

মদিনার যদিও অন্য প্রশ্ন! তিনি বলছেন, ‘‘আমাদের সংসার চলবে কী করে এ বার? ওরা আমাদের কথা ভাবল না! যারা এটা করেছে, তারাও ছোট, কিন্তু ইরশাদের ছোট বাচ্চা রয়েছে। ওই ছাত্রদের কথা ভাবতে গেলে আমার ভাইয়ের বাচ্চাদের কী হবে?’’

এ সব প্রশ্নের জবাব যদিও থমকে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE