E-Paper

জীব-বিজ্ঞানে নীতির লাগাম

২০০০ সালের গোড়ায়ও বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, এক দিন এমন ভাইরাস আসবে যার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান কিছুই করতে পারবে না। তখন বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

আরণ্যক গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫ ০৬:২৯

আজকের বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে নতুন নতুন জিন-সম্বলিত অণুজীব তৈরির ক্ষমতা, যাতে মানুষ পেতে পারে রোগমুক্ত দীর্ঘ জীবন। কিন্তু এই ক্ষমতা ডেকে আনতে পারে কল্পনাতীত বিপর্যয়। বিজ্ঞানীরা এখন আশঙ্কিত ‘মিরর ব্যাক্টিরিয়া’ বা প্রতিচ্ছবি-জীবাণু নিয়ে। এগুলি আমাদের চেনা জীবাণুর মতোই, কিন্তু আণবিক গঠনে ঠিক বিপরীত। আয়নায় যেমন আমাদের অবিকল এক ছবি পড়ে, শুধু ডান দিক দেখা দেয় বাঁ দিক হয়ে, তেমনই এদের ডিএনএ, প্রোটিন ও কোষীয় উপাদানের গঠন। আমাদের শরীরের জীবপ্রক্রিয়াগুলি নির্ভর করে ডি-শুগার (শর্করা) এবং এল-অ্যামিনো অ্যাসিডের উপর। এই প্রতিচ্ছবি-জীবাণু সেখানে গঠিত ডি-অ্যামিনো অ্যাসিড ও এল-শুগার দিয়ে। প্রকৃতিতে যা পাওয়া যায় না।

বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘চিরাল’ অণু। ‘চিরাল’ কথাটি এসেছে একটি গ্রিক শব্দ থেকে, যার মানে হাত। আমাদের ডান হাত আর বাঁ হাত একে অপরের বিপরীত, একটার উপর আর একটাকে রাখলে (‘সুপারইম্পোজ়’ করলে) মিলবে না। তেমনই হয় চিরাল অণু আর জৈব অণুর ক্ষেত্রেও। এই চিরাল অণু তৈরির ঝুঁকি বিষয়ে বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’-এর জীববিজ্ঞানী দীপা আগাশে বলেছেন, প্রতিটি জীববৈচিত্রপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রে এক ধরনের শত্রু-পক্ষ বিদ্যমান থাকে। যেমন ব্যাক্টিরিয়ার শত্রু ভাইরাস, পরজীবী, নানা জীব। কিন্তু চিরাল-জীবাণুর কোনও স্বাভাবিক শত্রু নেই। ফলে তারা হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুহীন, নিয়ন্ত্রণহীন।

যদি এই ব্যাক্টিরিয়াগুলি প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তারা ক্রমশ বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক ভারসাম্যকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। কারণ, প্রাকৃতিক ভাইরাস ও অন্যান্য অণুজীব এই চিরাল ব্যাক্টিরিয়াকে চিনতেই পারবে না। অদৃশ্য, অজেয় জীবাণু হিসাবে তারা বেঁচে থাকবে।

সম্প্রতি জীববিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলনে (এএসএম মাইক্রোবায়োলজি ফোরাম) এ বিষয়ে আলোচনা হয়। অনেকেই মনে করেন, এই ধরনের জীবাণু তৈরি করতে এখনও বছর দশক লাগবে। তবে চিরাল জৈবতন্ত্রের বিপদ নিয়ে এখন থেকেই সতর্ক করছেন তাঁরা। চিরাল অণুগুলিকে ব্যবহার করে জীবাণু তৈরি করা গেলে তা থেকে তৈরি হতে পারে এমন সব সংক্রমণ, যেগুলিকে মারতে পারবে না প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক।

বিশ্বের সেরা জৈব-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অন্যতম ক্লারা ডি-সান্তো মনে করেন, এই গবেষণা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে ‘বায়ো-হ্যাকিং’ হতে পারে, যা জৈব-সন্ত্রাসের পথ তৈরি করে দেবে।

তার মানে এই নয় যে, চিরাল-অণুর যে কোনও ব্যবহারই বিপজ্জনক। চিরাল প্রোটিন দিয়ে তৈরি ওষুধ শরীরে সক্রিয় থাকতে পারে দীর্ঘ দিন; ক্যানসার কোষে পৌঁছে নির্দিষ্ট প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন কোষকলা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু এখানেও উঠছে ‘সম্ভাবনা বনাম বিপদ’-এর বিতর্ক। বিজ্ঞান শুধু গবেষণার জন্য নয়, তা মানবকল্যাণের জন্য। কিন্তু আজ গবেষণা প্রায়ই হচ্ছে গোপনে, নীতি-নিয়মের বাইরে, রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে। তাই প্রশ্ন উঠছে, চিরাল-জীবাণু বিষয়ে নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব শুধু কি বিজ্ঞানীদের উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে, না কি জনসাধারণ, জননীতি নির্ধারকদেরও এই আলোচনায় যোগ দেওয়া উচিত? বিজ্ঞানী তো একা পথ দেখান না। বিজ্ঞান দেখায় আলো, ছড়ায় ছায়া, তার ভাগীদার গোটা মানবজাতি।

২০০০ সালের গোড়ায়ও বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, এক দিন এমন ভাইরাস আসবে যার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান কিছুই করতে পারবে না। তখন বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অনেকে মনে করেন, তারই ফলাফল কোভিড-১৯। আজ যদি আমরা চিরাল-জীবাণুর বিষয়ে মাথা না ঘামাই, তবে হয়তো পরবর্তী অতিমারির সূচনা হবে আমাদের তৈরি জীবাণু দিয়ে।

এই প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের জন্য দরকার তিনটি বিষয়— ১) নিয়ন্ত্রিত গবেষণাগার ২) আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা ও তথ্যের আদান-প্রদান ৩) একটি আন্তর্জাতিক নীতিগত কাঠামো। এগুলি কতখানি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। নয়া আবিষ্কারের ঝোঁক প্রায়ই বড় বড় ওষুধ সংস্থা ও বিজ্ঞানীদের নীতির বশ্যতাকে এড়িয়ে চলে। আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে। আমাদের সামনে এখন দু’টি পথ— এক দিকে অসীম প্রযুক্তির সম্ভাবনা, অন্য দিকে অনিয়ন্ত্রিত ভবিষ্যতের ঝুঁকি। চিরাল-জীবাণুর ছায়া শুধু বিজ্ঞানের কল্পকাহিনির অংশ নয়। তা যে কোনও দিন হয়ে উঠতে পারে এক বাস্তবিক বিপদ। ভারতের আর এক সুপরিচিত জীববিজ্ঞান গবেষক রঘুত্তমন ইয়েন্নামল্লি বলেন, “এখনই ‘হোয়াট ইফ’ কথোপকথন শুরু না করলে, ভবিষ্যতের কোনও এক সময়ে বিজ্ঞানই হয়ে উঠবে আমাদের সবচেয়ে বড় বিপদ।” তাঁর মতে, এখনই দরকার বিশ্ব জুড়ে জৈব-নীতিমালা তৈরি, যেখানে চিরাল-ভিত্তিক গবেষণাগুলিকে নিরাপদ পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখা হবে।

জৈবপ্রযুক্তি, ইউনিভার্সিটি অব আরকানস’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Science Bacteria medicine Virus

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy