Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Uttarakhand Disaster

Uttarakhand disaster: রাতভর বৃষ্টি, পাহাড়ের ঢালে ঝুলে ছিলাম আমরা

ঘন জঙ্গলে কেবল বৃষ্টি আর ধসের আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম আমরা। ধরেই নিয়েছিলাম, এখনই সাহায্য আসার কোনও সম্ভাবনা নেই।

পর্যটকদের উদ্ধার করছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী।

পর্যটকদের উদ্ধার করছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। ছবি: পিটিআই।

তনুশ্রী চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২১ ০৮:১২
Share: Save:

খাদের কোনায় তেরচা হয়ে ঝুলে থাকা ‘চটি’-টা যে কোনও সময়ে নীচে তলিয়ে যেতে পারত। কিন্তু উত্তরাখণ্ড জুড়ে হয়ে চলা প্রবল বৃষ্টির মধ্যে তখন ওই চটি ছেড়ে বেরোনোর কোনও উপায় নেই আমাদের। বৃষ্টি আর ধস নামার আওয়াজে রাতভর জেগে বসে আছি আমরা। সময় যত গড়াচ্ছে, আতঙ্ক ততই পেয়ে বসছে আমাদের আট জনের দলটাকে। স্থানীয় মালবাহকেরা ভরসা দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা বুঝতেই পারছি না, এত বৃষ্টিতে সরু পাহাড়ি পথ বেয়ে নামব কী করে।

প্রতি বছর পুজোর সময়ে ঘুরতে বেরোই আমরা। এর আগে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, মদমহেশ্বর ঘুরে এসেছি। এ বার ঠিক করেছিলাম, যাব রুদ্রনাথ। পায়ে হেঁটে। ইউটিউবে কিছু ভিডিয়ো রয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাস্তা যে এতটা দুর্গম তা বুঝতে পারলাম সাগর গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করার পরে। তবু যাওয়ার পথে কোনও সমস্যা হয়নি। ১৫ অক্টোবর পৌঁছে গেলাম রুদ্রনাথে। যে দিন পৌঁছলাম, তার পরের দিনই মন্দিরের শিবঠাকুরকে পাহাড় থেকে নামিয়ে আনার কথা। শীতকালটা তিনি নীচেই কাটাবেন।

প্রায় গোটা রাস্তায় মোবাইলের টাওয়ার নিখোঁজ। তাই উত্তরাখণ্ড জুড়ে যে বৃষ্টির পূর্বাভাস কিংবা লাল সতর্কতা জারি হয়েছে, মন্দির দর্শন সেরে ফেরার পথে সে কিছুই সব জানতে পারিনি। ১৬ অক্টোবর আমরা নীচে নামতে শুরু করার পরেই সঙ্গী হল বৃষ্টি। প্রথমে ঝিরিঝিরি, তার পর জোরে। পাহাড়ি বৃষ্টি নামতেই এক দিকে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ল। আবার রাস্তা পিছল হয়ে পড়ায় হাঁটাও মুশকিল হয়ে গেল। আমাদের দলে যেমন আমার ৫৯ বছরের মা রয়েছে, তেমনই রয়েছে ৯ বছরের বাচ্চা ছেলে। চিন্তা বাড়তে শুরু করল।

আকাশে কালো মেঘের স্তর আর অঝোর বৃষ্টির চাদরে বেলা দু’টোতেই তখন রাতের অন্ধকার। হোঁচট খেতে খেতে কোনও রকম এসে পৌঁছলাম কালনাচাঁদে। পথের এক পাশে ছোট্ট চটি। এতটাই ছোট, যে ওঠার পথে আমাদের তেমন নজরেই পড়েনি। কিন্তু এখন সেটাই হয়ে উঠল আমাদের আশ্রয়। পাহাড়ে বৃষ্টির গতিপ্রকৃতি আঁচ করে চটির মালিক নীচে চলে গিয়েছেন। কয়েক জন মালবাহককে নিয়ে ওই চটিতেই আমরা মাথা গুঁজলাম। সঙ্গে সামান্য কিছু খাবার ছিল, সে রাতে খিদে মিটল তা দিয়েই। পরের দিন সকালে দেখি, পাহাড়ের ঢালে এক কোণে তেরচা হয়ে ঝুলে রয়েছে আমাদের চটি। যেন সামান্য টোকা দিলেই নীচে নেমে যাবে হুড়মুড়িয়ে।

বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষণ নেই। কিন্তু আমরা তখন নীচে নামতে মরিয়া। অভিজ্ঞ মালবাহকেরা বোঝালেন, নীচে যাওয়ার পথে যে শুকনো ঝোরাগুলো ছিল, সেগুলো বর্ষার জল পেয়ে এখন দুরন্ত নদীর চেহারা নিয়েছে। এখন তা পার হওয়া বিপজ্জনক। পরিস্থিতি যা বুঝলাম, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এ দিকে কারও মোবাইলেই টাওয়ার নেই। সঙ্গে থাকা টর্চ আর সোলার লাইটের ব্যাটারি ফুরোনোর মুখে। কোনও ভাবে একটা মোবাইলে টাওয়ার আসতেই দ্রুত যোগাযোগ করলাম উত্তরাখণ্ড প্রশাসনের সঙ্গে।

এক দফতর থেকে আর এক দফতর ঘুরে অবশেষে কেদারনাথ বন বিভাগের সঙ্গে যখন যোগাযোগ হল, তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। তাঁরা জানালেন, রাতের মধ্যেই লোক পাঠাচ্ছেন।

আকাশ তখন অন্ধকার। ঘন জঙ্গলে কেবল বৃষ্টি আর ধসের আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম আমরা। ধরেই নিয়েছিলাম, এখনই সাহায্য আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু অসাধ্য সাধন করে সেই রাতেই বন বিভাগের দু’জন কর্মী এসে পৌঁছলেন আমাদের চটিতে। সঙ্গে রেনকোট ও শুকনো খাবার। আরও এক কর্মী রয়ে গিয়েছিলেন কিছুটা নীচে, ঝোরা পার হতে যাতে সমস্যা না হয়, সেই ব্যবস্থা করার জন্য। বন বিভাগের কর্মীদের আনা শুকনো খাবার খেয়ে ফের রাত কাটানো হল ঝুলে থাকা চটিতে। আলো ফুটতেই হাঁটা শুরু। ওই পিছল পথেই কোনও রকমে হেঁটে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে ঝোরা পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম সাগরে। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমাদের গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলেন বন বিভাগের কর্মীরা। এখনও ভাবি, ওই ঝড়-জলের মধ্যে প্রাণ বিপন্ন করে তাঁরা যদি সময়ে না আসতেন, জানি না কী হত!

(লেখক স্নাতকোত্তরের ছাত্রী)

অন্য বিষয়গুলি:

Uttarakhand Disaster
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE