দায়িত্ববান: আলিপুর চিড়িয়াখানায় আশিসবাবু। নিজস্ব চিত্র
প্রশ্ন: পটাশপুরের গল্প বলুন না? বাবা, মা, পরিবার, সব কিছু।
উত্তর: আমাদের গ্রামের নাম কিন্তু নূতনপুর। বাবা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। মা, দাদা আর এক বোন।
প্রশ্ন: পড়াশোনা কি গ্রামের স্কুলেই?
উত্তর: মাধ্যমিক দিয়েছিলাম মকরামপুর নীলকণ্ঠ শিক্ষা সদন থেকে। তারপর কিছুদিন এগরা ঝাটুলাল হাইস্কুলে পড়ি। সেখান থেকে বনমালীচট্টা হাইস্কুলে। মেদিনীপুর কলেজ থেকে বিএসসি স্নাতক।
প্রশ্ন: কোনও স্যরের কথা মনে পড়ে?
উত্তর: তিনি মেদিনীপুর কলেজের বটানির অধ্যাপক অগম প্রসাদ রায়। তাঁর প্রেরণা এবং উপদেশেই আমি এই জায়গায় আসতে পেরেছি। ওঁর সঙ্গে এখনও আমার যোগাযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: ছোটবেলা থেকেই কি বন্যপ্রাণে আগ্রহ?
উত্তর: গ্রামের ছেলে। ছোটবেলায় যা হয় আর কী! গ্রামে প্রচুর খ্যাঁকশিয়াল। গর্তে থাকে। অনেক মুখ সেই গর্তের। স্কুল থেকে ফেরার পথে শিয়ালের গর্তের মুখগুলো বুজিয়ে দু’একটা খোলা রাখতাম। তারপর ধোঁয়া দিলে শিয়ালগুলো ছুটে পালাত। বন থেকে টিয়া পাখি, পেঁচার বাচ্চা নিয়ে এসে পুষতাম। তারপর বড় হলে বনে ছেড়ে দিতাম। ছোটবেলার মজা। খুব খারাপ ছিল কাজগুলো।
প্রশ্ন: ফরেস্ট সার্ভিসে আসার বিশেষ কোনও কারণ আছে?
উত্তর: সেরকম কিছু নয়। চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল বনমালীচট্টা স্কুলে। দু’বছরের বেশি ওখানে পড়িয়েছিলাম। তারপর ফরেস্ট সার্ভিস দিলাম। দেহরাদূনে প্রশিক্ষণ। ফিরে এসে দেখি, স্কুলে যোগ দেওয়ার চিঠি এসেছে। জঙ্গলই বেছে নিলাম।
প্রশ্ন: তারপর জঙ্গলে চোরাচালানকারীদের ত্রাস হয়ে উঠলেন? চোরাচালান রোখার ক্ষেত্রে আপনার ভূমিকার কথা ওয়াকিফহাল মহলে বেশ শোনা যায়। অভিজ্ঞতা?
উত্তর: একটা ঘটনার কথা বলি। তখন সাত মাস বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। যাচ্ছিলাম কামাখ্যা। আলিপুরদুয়ার স্টেশনে ট্রেনে ওঠার আগে হঠাৎ পাখির আওয়াজ কানে এল। জঙ্গলের ময়না পাখির ডাক। মাঝে মাঝেই ডাকছে। তার মানে ট্রেনে পাখি পাচার হচ্ছে। আন্দাজ করলাম, নিশ্চয় স্টেশনের লাগেজ রুমে পাখির খাঁচা রাখা আছে। স্টাফকে ডাকতে যাব তখনই চোখে পড়ল এলাকার এক চোরাশিকারিকে। ও চিতাবাঘের বাচ্চা, ধনেশ পাখি, ময়না পাচার করত। ওকে ধরার জন্য বন দফতর হন্য হয়েছিল। আমি ওকে চিনতাম। ওর বাড়িতে রেড করেছিলাম। কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে যায়।
প্রশ্ন: রেড করার গল্পটাও তো মনে হয় আকর্ষণীয়?
উত্তর: খবর ছিল, ওর বাড়িতে পাখি রাখা আছে। তখন আমি শিক্ষানবিশ। ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হল না। বলা হল, মেয়েরা আছেন। ওইটুকু অপেক্ষায় লোকটা পাখি সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলাম। পাখির বিষ্ঠা ছিল ওর ঘরে। ধরতে না পারায় সেদিন আমাকে হেনস্থা করা হয়েছিল।
প্রশ্ন: আলিপুরদুয়ারের ঘটনায় ফেরা যাক?
উত্তর: স্টেশনের লাগেজ রুমে কিন্তু পাখি পাইনি। লোকটার স্টেশনে উপস্থিতি এবং পাখির ডাকে আমি নিশ্চিত চোরাচালান হচ্ছেই। হঠাৎ দেখলাম, ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে। ছুটলাম সেদিকে। ওই ট্রেনের লাগেজ ভ্যান তখন সবে বন্ধ করছে। রেলকর্মীকে বললাম, আমার জিনিস রয়েছে। একটু খুলুন। লোকটা প্রথমে নারাজ ছিল। তারপর খুলতেই দেখলাম, পাখি ভর্তি খাঁচা। অন্তত ৩০০-৪০০ পাখি। স্ত্রী, শ্বশুর শাশুড়িকে বললাম, আমাদের আর কামাখ্যা যাওয়া হবে না। মিসেসকে বললাম টিকিট ক্যানসেল করার জন্য। প্ল্যাটফর্মের সেনাদের দেখিয়ে বললাম, অসুবিধা হলে ওদের সাহায্য নেবে।
প্রশ্ন: লোকটাকে তো ধরা গেল না?
উত্তর: শুনুন না তারপর। অফিসে খবর দিয়েছি। যে যেখানে যেমন অবস্থায় ছিলেন চলে এসেছিলেন। বাগানের মালি পর্যন্ত। কেউ লুঙ্গি পরে। অনেক খুঁজে শেষে স্টেশনে আসার অন্য একটা রাস্তা থেকে চোরাশিকারিকে ধরা হয়। পরে অবশ্য ওই শিকারি বন দফতরকে বহু সাহায্য করেছিল।
প্রশ্ন: এ রকম অভিজ্ঞতা আরও বলুন?
উত্তর: শিলিগুড়ির মহানন্দা আর অসমের সংকোশ নদী দিয়ে প্রচুর কাঠ পাচার হত। একবার কাঠ পাচার হচ্ছে মহানন্দা দিয়ে। পাচারকারীরা মাঝ নদীতে। আমি নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে গেলাম। ওরা গালাগাল করছিল। আমি সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাঁতার জানো? সঙ্গী হ্যাঁ বলতেই চিৎকার করলাম, সাঁতার জানি না বলে বেঁচে গেলি। না হলে...। চোরাচালানকারীরা উৎসাহিত হয়ে নদীর পাড়ের দিকে এসে গালাগাল শুরু করল। আরেকটু কাছে আসতেই আমরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ধরেছিলাম ওদের।
প্রশ্ন: কোথায় কোথায় পোস্টিং ছিল?
উত্তর: বক্সা, কোচবিহার, বৈকুণ্ঠপুর, মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে। ২০১৫ সালে আলিপুর চিড়িয়াখানার দায়িত্ব পাই।
প্রশ্ন: ঝাড়গ্রাম চিড়িয়াখানার আধুনিকীকরণের আপনার ভূমিকা রয়েছে তো?
উত্তর: আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। আমি ভাগ্যবান যে এখানে পোস্টিং হয়েছিল। আমার হাতেখড়ি হয় এখানে। ঝাড়গ্রাম চিড়িয়াখানার সম্ভাবনা রয়েছে। এলাকা আলিপুরের থেকে বড়। পরিবেশ ভাল।
প্রশ্ন: ঝাড়গ্রামে হোম স্টে ট্যুরিজমের শুরু করেছিলেন আপনি। পরিকল্পনা কী ভাবে মাথায় এল?
উত্তর: উত্তরবঙ্গ থেকে। সেখানে অনেক হোম স্টে রয়েছে। ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গ্রামের মানুষকে যদি সরকার বাড়ি করে দেয় তাহলে পর্যটন আর কর্মসংস্থান একই সঙ্গে হয়।
প্রশ্ন: মেদিনীপুরের ডিএফও থাকার সময়ের অভিজ্ঞতা কী রকম?
উত্তর: মাওবাদীদের রমরমার সময়ে মেদিনীপুরের দায়িত্বে ছিলাম। বন দফতর সেই সময়ে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে অনেক কাজ করেছে। লালগড়ে গভীর নলকূপ তৈরি করে জলের ব্যবস্থা করেছিল বন দফতর। ওই সময়ে সেখানে কী ভাবে কাজ হবে তা নিয়ে ঠিকাদারের সংশয় ছিল। কাজ শুরুর পরে সেখানে মাওবাদীরা গিয়েছিল। ভয় পাচ্ছিলেন কর্মীরা। কিন্তু ওরা কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, কাজটা যেন ভাল হয়। পরে ওই এলাকা পরিদর্শনে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। আমলাশোলেও বন দফতর স্থানীয়দের অনেক কাজের ব্যবস্থা করেছিল।
প্রশ্ন: মেদিনীপুরের বন এবং বন্যপ্রাণের অবস্থা কী রকম বলে মনে হয়?
উত্তর: জঙ্গল ভাল আছে। ভাল আছে বলেই বুনো প্রাণীরাও ঠিকঠাক রয়েছে। সেই জন্যই ওরা মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে।
প্রশ্ন: আর বাঘ?
উত্তর: লালগড়-রামগড় সীমানায় জঙ্গল বেশ ঘন। জল আছে। খাবার রয়েছে। ওই এলাকায় বাঘ থাকার পক্ষে অনুকূল। খবরে তো ওই এলাকার কথাই উঠে আসছে।
প্রশ্ন: বাড়ি যাওয়া হয়?
উত্তর: মাঝে মাঝে। বাবা, মা রয়েছেন। আমার দাদা অশোক সামন্ত কলকাতার এক হাসপাতালের চিকিৎসক। আমার অন্যতম অনুপ্রেরণা। আমরা কলকাতায় থাকি। বোন মেদিনীপুরেই থাকে।
প্রশ্ন: এত বড় পদ, বন দফতরে চোরাচালান রোখায় আপনার ভূমিকার প্রশংসা, ছেলে-মেয়ে, এত সবের মধ্যে কোনটা সেরা?
উত্তর: বনমালীচট্টায় যখন জীববিদ্যা পড়াতাম তখন কয়েকজন ছাত্র ছিল। তারা এখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। ভালবাসে। ছাত্রদের স্বীকৃতি জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy