গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
অভিযোগ প্রচুর। তবে আদালতগ্রাহ্য প্রমাণ কার্যত কিছুই জমা পড়েনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর। যদিও ওই অভিযোগের বেশ কয়েকটি ধরে ধরে রীতিমতো প্রশ্ন করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। ‘ঠিক পথেই তদন্ত চলছে’, বলে জানিয়ে শীর্ষ আদালতে দফায় দফায় রিপোর্টও দিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। কিন্তু ৯০ দিনের মধ্যেও চার্জশিট দিতে না-পারায় সিবিআইয়ের উপরে কার্যত আদালতগ্রাহ্য প্রমাণ সংগ্রহ না করতে পারার দায়ই বর্তেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তার ফলেই আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল জামিন পেয়ে গিয়েছেন বলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। তাঁরা এখন প্রশ্ন তুলেছেন, গুরুতর সব অভিযোগ সামনে এলেও সে সবের যথাযথ তদন্ত আদৌ হয়েছে তো?
রবিবার নিহত ডাক্তার ছাত্রীর বাবাও বলেন, “পুরোটাই সিবিআইয়ের গাফিলতি। সিবিআই সুযোগ করে দিল বলেই সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের জামিন হল। সিবিআই কিছু না করলে আর কোথায় যাব! আশা করব ওরা ঠিকঠাক করে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করবে। আন্দোলন করেই আমাদের বিচার ছিনিয়েআনতে হবে!”
সিবিআই সূত্রে অবশ্য এ দিন দাবি করা হয়, প্রমাণ না থাকলে থানার ওসির মতো কোনও সরকারি অফিসারকে হাজতে ভরার পথে তারা হাঁটত না এবং আগেই গ্রেফতার হওয়া হাসপাতালের অধ্যক্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাউকে নতুন করে মামলায় যুক্ত করা হত না। আগামী দিনে দ্রুত সমস্ত প্রমাণ হাতিয়ার করে মামলা সাজিয়ে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেওয়া হবে। তদন্তকারীদের সূত্রের দাবি, আর জি করের খুন এবং ধর্ষণের ঘটনা কে ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে এবং কী ভাবে ঘটিয়েছের থেকেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই তদন্তে পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। মূল তদন্তে হস্তক্ষেপ করতে না চাওয়ার কথা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টও দফায় দফায় এই দিকটি নিয়েই আলোচনা করে। সে দিক থেকে এমন গুরুতর ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের বিষয়টি মোটেও ছোট অপরাধ নয়। সরাসরি ধর্ষক এবং খুনির সাজার ব্যবস্থা করার মতোই এই মামলাকে বিপথে চালিত করে খুনি বা ধর্ষককে আড়াল করতে চেয়েছে যারা, তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য যথাযথ তদন্ত হয়েছে।
কিন্তু ঠিক কী তথ্যপ্রমাণ মিলেছে বলে সিবিআই সূত্রে দাবি করা হচ্ছে? সূত্রের দাবি, আর জি করে মৃতদেহ উদ্ধারের পর যে বিষয়গুলি সামনে এসেছিল, তার মধ্যে প্রধান ছিল, সকাল ১০টায় মৃতদেহ দেখা গেলেও পুলিশ এফআইআর রুজু করতে রাত পৌনে ১২টা বাজিয়ে ফেলেছিল। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে কেন এফআইআর দায়ের করা হল? সুপ্রিম কোর্টের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সিবিআই দেখে, এই মৃত্যুকে প্রথমেই ‘আত্মহত্যা’ বা ‘একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু’র মামলা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সেই মতো সকালে থানায় জিডি লিখে বেরোয় পুলিশ। সেই জিডি নম্বরের ভিত্তিতে একটি এফআইআর-এর বয়ান পর্যন্ত লেখা হয়ে যায়। এ ব্যাপারে দফায় দফায় থানার পুলিশকর্মীদের পদস্থ পুলিশ কর্তাদের তরফে ওয়টসঅ্যাপ কলে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রশাসনিক নানা স্তর থেকেও এই সময় থানার অফিসারদের সঙ্গে কথা বলা হয় বলে সিবিআই সূত্রের দাবি। কিন্তু পরে ময়না-তদন্ত হয়ে গেলে বহু কাটাকুটি করে চূড়ান্ত এফআইআর লেখা হয়। সেই এফআইআরে (এফআইআর নম্বর ৫২) শেষ পর্যন্ত লেখা থাকে, ‘আননোন মিসক্রিয়েন্টস কমিটেড উইলফুল রেপ উইথ মার্ডার’। যা নিয়ে প্রবল বিতর্কও হয়। আইনের ভাষায় ‘উইলফুল রেপ’ বা ‘ইচ্ছাকৃত ধর্ষণ’ বলে কিছুই হয় না, বলে সরব হন আইনজীবীদের অনেকেই। সিবিআই সূত্রের দাবি, দেখা গিয়েছে তড়িঘড়ি বয়ান বদল করতে গিয়েই এফআইআরের কাগজে এমন লেখা রয়ে গিয়েছিল।
কেন হাসপাতাল থেকেই অধ্যক্ষ বা সুপারের তরফে পুলিশে অভিযোগ জানানো হল না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সিবিআই সন্দীপের থানায় পাঠানো সে দিনের একটি মেল পায়। সেই মেলের বয়ানেও একটি সংজ্ঞাহীন দেহ পড়ে থাকার কথা লেখা হয়েছে বলে দেখেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। যে মৃতদেহ দেখে একজন সাধারণ মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে এটি খুনের ঘটনা, সেই মৃতদেহ দেখে সন্দীপের মতো চিকিৎসকের বুঝতে সমস্যা হল কেন এবং কেন শুধুমাত্র একটি সংজ্ঞাহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে বলে লেখা হল, সেই উত্তর খুঁজতে শুরু করেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। সূত্রের দাবি, এই পথেই সন্দীপের সঙ্গে একাধিক প্রভাবশালীর মোবাইলে কথোপকথনের প্রমাণ পান তদন্তকারীরা। তৎকালীন ওসি অভিজিতের সঙ্গে প্রাক্তন অধ্যক্ষের বেশ কিছু ‘গোলমেলে কথোপকথন’-এর আভাসও সিবিআই পেয়েছে বলে সূত্রের দাবি। পারস্পরিক বেশ কয়েকটি ফোন কলের নথি দু’জনেই নিজেদের ফোন থেকে মুছে দিয়েছিলেন বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ। পরে সেগুলি পুনরুদ্ধার করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তার রিপোর্ট এসে গিয়েছে। তাতেই ময়না তদন্ত প্রভাবিত করারও বেশ কিছু চেষ্টা বোঝা গিয়েছে বলে সূত্রের খবর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তড়িঘড়ি ময়না-তদন্ত করিয়ে মৃতদেহ দাহ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সিবিআই জেনেছে। মৃতার পরিবার মৃতদেহ সংরক্ষণ করার দাবি জানালেও তা-ও যে শোনা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সিবিআই তার প্রমাণ পায় বলে সূত্রের খবর।
এর পরে রয়েছে যথাযথ ভাবে নমুনা সংগ্রহ না করার অভিযোগ। যে হেডফোনের সূত্র ধরে প্রথমে পুলিশ এই ঘটনায় ধৃত সঞ্জয় রায়কে চিহ্নিত করে, তা কোথায় পড়ে ছিল, তা ঠিকঠাক সিজ়ার তালিকায় না বলা— ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ সংগ্রহ করে সিবিআই। এর পরই ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ২৩৮ ধারা (তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা এবং এমন তথ্য দেওয়া যাতে অপরাধীকে আড়াল করা যায়), ১৯৯ ধারা (সরকারি কর্মীর আইন অমান্য) এবং ৬১ ধারা (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) যুক্ত করে সন্দীপ আর অভিজিতের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের একটি সূত্রের দাবি, থানা এবং হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ না-মেলাই এই দু’জনের গ্রেফতারির ক্ষেত্রে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ইচ্ছাকৃত ভাবে তদন্তের অভিমুখ ঘোরাতে তা মুছে ফেলা হয়েছিল বলে তথ্যপ্রমাণ সিবিআই হাতে পায় বলে ওই সূত্রের দাবি।কিন্তু এত কিছু হাতে পেয়ে থাকলে সিবিআই চার্জশিট দিতে পারল না কেন? না কি ইচ্ছাকৃত ভাবে দেওয়া হল না? মূল মামলা প্রভাবিত হতে পারে, এই দাবিই বা কতটা ঠিক? এই সব প্রশ্নের কোনওটিরই এখনও স্পষ্ট উত্তর মিলছে না। এখন নতুন কৌঁসুলিরাখার কথা ভাবছেন বলেও জানান নিহত চিকিৎসকের বাবা। তিনি বলেন, “শুভেন্দু অধিকারীর মতো বিজেপির কয়েক জনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। ওঁরা প্রথম দিন থেকে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।’’ এ বার থেকে বিচার কেমন চলছে দেখতে নিয়মিত আদালতে যাবেন বলেও জানান তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy