তখন বয়স ছিল ৫। এখন ১৮। এ বারই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। হাওড়ার সালকিয়ার পৌলমী আটা বলছেন, ‘‘১৩টা বছর পেরিয়ে গেল! অথচ এখনও বাবার মৃত্যুর শংসাপত্রটা পেলাম না। মা-ও গত বছর মারা গেলেন। কী ভাবে যে দিন কাটছে!’’
১৩ বছর আগে সেই দিনটা ছিল ২৭ মে। রাত তখন দেড়টা। কিছু ক্ষণ আগে খড়্গপুর ছেড়ে ঘণ্টায় প্রায় ৭০ কিমি গতিবেগে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস ছুটছিল মুম্বইয়ের দিকে। সর্ডিহার রাজাবাঁধ এলাকা, এখন যে জায়গাটি ঝাড়গ্রাম জেলায়, সেখানে হঠাৎ লাইন থেকে ছিটকে পড়েছিল ট্রেনটি। চালক বিভয়কুমার দাস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে বুঝেই এমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে ডাউন লাইনে উল্টো দিক থেকে মালগাড়ি চলে আসায় সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। সেই ঘটনায় ১৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত শতাধিক। কয়েক জনের অঙ্গহানিও হয়। মালগাড়ির চালক মারা যান।
ওই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে, এমন ২৪ জনের পরিবার এখনও মৃত্যুর শংসাপত্র পায়নি। খাতায়কলমে তাঁরা নিখোঁজ। বছরের পর বছর আইনি লড়াই চলছে। জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল হাওড়ার সালকিয়ার প্রসেনজিৎ আটার। স্ত্রী যূথিকা নিজের অসুস্থতার মধ্যে সুবিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হন। প্যারালিসিসে ভুগছিলেন। ডায়ালিসিসও করাতে হচ্ছিল। গত বছর যূথিকার মৃত্যু হয়েছে। এখন ‘লড়ছেন’ মেয়ে পৌলমী। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে হারিয়েছেন কলকাতার হেয়ার স্ট্রিট থানা এলাকার বাসিন্দা সুরেন্দ্র সিংহ। সুরেন্দ্রও বলছেন, ‘‘স্ত্রী নীলম ও এক ছেলে রাহুলের দেহ আজও শনাক্ত হয়নি। রেল ও রাজ্যপ্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। কোনও সদুত্তর পাইনি।’’ তাঁর আশঙ্কা, ‘‘এ বারও হয়তো অনেকেরইকপাল পুড়বে।’’
সূত্রের খবর, জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনার পরে ৩৭ জনের দেহ শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। পরে ডিএনএ পরীক্ষা হয়। ধাপে ধাপে ১৩ জনের দেহ শনাক্ত হয়। তাঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ৯ জন। বাকি ২৪ জনের দেহ এখনও শনাক্ত করা যায়নি। সেই সব দেহ পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতার তিন হাসপাতালের মর্গে। এই ২৪ জনের পরিবার মৃত্যুর শংসাপত্রও পায়নি। এই পরিবারগুলি পেয়েছে ক্ষতিপূরণ, রেল এবং রাজ্য দু’তরফেই। তবে মৃত্যুর শংসাপত্র না মেলায় স্বজনের চাকরি হয়নি। চাকরির প্রতিশ্রুতি ছিল রেলের তরফে। নিয়মানুযায়ী, সাত বছর কারও খোঁজ না মিললে তাঁর পরিবারকে আদালতে আবেদন করতে হয়। আদালত সব দিক বিবেচনা করে নিখোঁজকে ‘মৃত’ ঘোষণা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশাসন মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ জন্যই শেষে ঝাড়গ্রাম আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন যূথিকারা। মামলা এখনও চলছে।
পৌলমীদের আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভকত বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার পরে নেতা-মন্ত্রীরা পাশে থাকার আশ্বাস দেন। পরে আর সেই সহানুভূতি থাকে না।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘কোর্টে এখন রেল এক রকম কথা বলে, জেলা প্রশাসন আর এক রকম। মৃত্যু হয়েছে বলেই তো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। তা হলে মৃত্যুর শংসাপত্র কেন দেওয়া হবে না?’’ তীর্থঙ্করের আশঙ্কা, ‘‘দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল, যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের বেশ কিছু যাত্রীর পরিবারকেও এমন অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে।’’ স্বজনহারা সুরেন্দ্রও বলছেন, ‘‘রেলের নিরাপত্তার দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হলে হয়তো এমন ঘটনার পুরনাবৃত্তি এড়ানো যেত।’’
এই পরিবারগুলির থেকে একটু হলেও আলাদা পরিস্থিতি বরোদার বাসিন্দা মালা সেনের। ২০০৯ সালের সেই রাতে জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনায় তিনি কপালে চোট পান। তবে গুরুতর জখম হন তাঁর ছেলে এবং মেয়ে। সে দিন এস-৭ কামরার যাত্রী মালা এ দিন বলেন, ‘‘কাল রাতে দুর্ঘটনার কথা শোনার পর থেকে বার বার সেই রাতের কথা মনে পড়ছে। সে রাতের প্রায় গোটা কাটিয়েছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে। চারদিকে কান্না, গোঙানির শব্দ— সবই যেন বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল। একটা দুর্ঘটনা যে কী ভাবে সব উলটপালট করে দিতে তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)