কারও ২৪ ঘণ্টা পরেই ট্রেনে চাপার কথা। কেউ সবে গিয়ে পৌঁছেছেন জম্মুতে। পহেলগাঁওয়ে মঙ্গলবার যখন জঙ্গিরা পর্যটকদের উপর নাগাড়ে গুলি চালাচ্ছে, তখনও তাঁরা স্বপ্ন দেখেছেন ‘ফিরদৌস বার রো-এ জমিন’ অর্থাৎ ‘মর্ত্যের স্বর্গে’ রম্যসফরের। আপাতত সেই স্বপ্ন ঝাঁঝরা পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের লক্ষ্য করে চলা ইস্পাতের বুলেটে। তার বদলে কাশ্মীর নামের সঙ্গে নতুন করে জুড়েছে আতঙ্ক। যার প্রভাব পড়েছে ভূস্বর্গের ভ্রমণশিল্পে। মঙ্গলবার ওই ঘটনার পর থেকেই ফোনের পর ফোন আসতে শুরু করেছে ট্রাভেল এজেন্টদের দফতরে। ও প্রান্তে মোটামুটি বাঁধাধরা প্রশ্ন— “দাদা, ট্যুর বাতিল করছেন তো?”
গরম পড়তে না পড়তেই কাশ্মীরের যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছিলেন ভ্রমণপ্রেমীরা। চলতি সপ্তাহেই বাংলা থেকে পর্যটকদের বহু ভ্রমণ সংস্থার যাওয়ার কথা ছিল কাশ্মীরে। সেই সফরের টিকিট কাটা থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। পর্যটকেরাও ভ্রমণ সংস্থাগুলিকে দিয়ে দিয়েছিলেন মাথাপিছু অর্থ। মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলার পরে তাঁদের অধিকাংশই কাশ্মীরে বেড়ানোর পরিকল্পনা বাতিল করছেন। শহরের অন্যতম পুরনো এবং জনপ্রিয় এক ভ্রমণ সংস্থার দফতরের কর্মী সমীর দাশগুপ্ত যেমন জানাচ্ছেন, বৃহস্পতিবারেই তাঁদের একটি ৩০-৪০ জনের দলের কাশ্মীরে যাওয়ার কথা ছিল। মঙ্গলবারের ঘটনার পরে তাঁরা নিজেরাই বাতিল করেছেন সেই ট্যুর। যাঁদের যাওয়ার কথা ছিল, তাঁদের ফেরত দেওয়া হচ্ছে টাকাও। সংস্থার কর্তৃপক্ষ বলছেন, ‘‘এর পরেও কাশ্মীরের ট্যুর ছিল ১ মে এবং ৮ মে। ওই দুই সফরে যাঁদের যাওয়ার কথা ছিল, তাঁরাও অনেকে ফোন করে জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীর যেতে চাইছেন না তাঁরা। ফলে তাঁদেরও বেড়ানোর অগ্রিম বুকিংয়ের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। গাড়ি, হোটেল, সবই বুকিং হয়ে গিয়েছিল। ফলে ক্ষতিও হচ্ছে।’’

যাঁরা ইতিমধ্যেই কাশ্মীরে পৌঁছে গিয়েছেন, তাঁদের কী অবস্থা? ছবি: পিটিআই, রয়টার্স।
কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা এর আগেও হয়েছে। গত বছরই অমরনাথ যাত্রীদের বাসে হামলা হয়েছিল। তবে মঙ্গলবার পহেলগাঁওয়ে যেমন হল, পর্যটকদের উপর সেই ধরনের হামলা সচরাচর হয় না কাশ্মীরে। একেবারে বিরল না হলেও ওই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বহু বছর আগে। আর ঠিক সেই কারণেই আতঙ্কের পাল্লা কিছুটা ভারী। পহেলগাঁওয়ের মাটিতে পড়ে থাকা তরুণ পর্যটক এবং তাঁর পাশে বসে থাকা সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর ছবি দেখে শিউরে উঠেছেন গত কয়েক বছরে নিশ্চিন্তে কাশ্মীরে বেড়াতে যাওয়া ভ্রমণার্থীরা। মুর্শিদাবাদের ট্রাভেল এজেন্ট গোপীনাথ দাস যেমন বলছেন, ‘‘গত কয়েক বছরে কাশ্মীর বেড়ানোর চাহিদা অনেক বেড়েছিল। গরম পড়লেই কাশ্মীরে যাওয়ার চাহিদা বাড়ত। মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসে প্রতি বছরই অনেকগুলি কাশ্মীর ট্যুর করিয়েছি আমরা। এ বছরও এপ্রিল-মে মাস মিলিয়ে তিনটি ট্যুরপ্ল্যান চূড়ান্ত ছিল। এর মধ্যে একটি দল এখন কাশ্মীরেই। ২৯ তারিখ ফেরার কথা তাদের। বাকি দু’টি দলের একটির রওনা হওয়ার কথা ২৮ এপ্রিল, অন্যটি মে মাসে। আপাতত ২৮ এপ্রিলটা বাতিল করেছি। মে মাসেরটা পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে বাতিল হলে বড় ক্ষতি হবে। আমাদের মতো ভ্রমণ সংস্থার জন্য এই ধরনের ঘটনা বড় ধাক্কা।’’
কাশ্মীর যাঁরা যাবেন ভেবেছিলেন, তাঁরা না হয় বাতিল করতে পারছেন, কিন্তু যাঁরা ইতিমধ্যেই কাশ্মীরে পৌঁছে গিয়েছেন, তাঁদের কী অবস্থা? পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগ অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্ট তথা কলকাতার এক ভ্রমণ সংস্থার অপারেশনাল ম্যানেজার কৌমিক ঘোষ বলছেন, ‘‘আমাদের দু’টি বেড়ানোর দল কাশ্মীরে রয়েছে এখন। এর মধ্যে একটি দল মঙ্গলবার পহেলগাঁওয়েই ছিল। জঙ্গি হামলার খবর পেয়েই তাদের বুধবার ভোরে পহেলগাঁও থেকে বার করে আনা হয়েছে। দুপুরে ওই দলটির শ্রীনগরে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কনভয়ের নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের। ওই দলটিকে শুক্রবারই ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও ৩০-৩৫ জনের একটি দল বুধবার জম্মুতে পৌঁছেছে। তাঁদের ফেরার কথা ছিল এক সপ্তাহ পরে। ওঁদেরও পরের দিনই ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছি। এতে অনেক ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু পর্যটকদের নিরাপত্তার সঙ্গে তো আর সমঝোতা করতে পারি না।’’

পর্যটকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাশ্মীর ভ্রমণে যেতে চাইছেন না। ছবি: পিটিআই, রয়টার্স।
তবে কাশ্মীরের ঘটনায় আগামী ভ্রমণ বাতিল করার মানুষ যেমন রয়েছেন, তেমনই এমনও অনেকে রয়েছেন, যাঁরা পহেলগাঁওয়ের ঘটনার কথা শোনার পরেও ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করেননি। বর্ধমানের ট্রাভেল এজেন্ট দীপঙ্কর দে-র ভ্রমণ সংস্থার আগামী ১১ মে কাশ্মীর যাওয়ার কথা ন’দিনের জন্য। দীপঙ্কর জানাচ্ছেন, মঙ্গলবারের ঘটনার পরেও তাঁর কাছে বেড়ানো বাতিল করতে চেয়ে কোনও ফোন আসেনি। তিনি বলছেন, ‘‘বরং দু’-এক জন ফোন করে জানতে চেয়েছেন, যাওয়াটা হচ্ছে কি না। তবে যেহেতু পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার রয়েছে, তাই আমরাই ফোনে ওখানকার হোটেল কর্তৃপক্ষ, গাড়ির চালকদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলছি। নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য।’’
পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার ঘটনায় শুধু বাংলা নয়, প্রভাব পড়েছে সর্বভারতীয় ভ্রমণশিল্পেও। ট্রাভেল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া প্রাক্তন প্রধান এবং বর্তমানে ট্যুরিজ়ম অ্যান্ট হসপিটালিটি স্কিল কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন জ্যোতি মায়াল বলছেন, “পহেলগাঁও-সহ গোটা কাশ্মীরেরই প্রচুর হোটেল বুকিং বাতিল হতে শুরু করেছে মঙ্গলবারের পর থেকে। শুধু আগামী কয়েক দিনের নয়, জুন মাস পর্যন্তও হোটেল বুকিং বাতিল হয়েছে। কারণ, পর্যটকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাশ্মীর ভ্রমণে যেতে চাইছেন না।’’

পহেলগাঁওয়ের ঘটনায় কি পর্যটকদের পুরনো কাশ্মীর-আতঙ্ক আবার চেপে বসবে? ছবি: পিটিআই, রয়টার্স।
স্বাতী ধিংড়া নামে দিল্লির এক বাসিন্দা সর্বভারতীয় সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যেমন জানিয়েছেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁর সপরিবার কাশ্মীর বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। ডাল লেকে হাউসবোটে, পহেলগাঁওয়ের একটি রিসর্টে বুকিংও করা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলার খবর শোনার পর থেকে তাঁর মনে হচ্ছে, এই ঘটনা আর কয়েক দিন পরে হলে তো ওই গুলির সামনে তাঁদেরও পড়তে হতে পারত। নয়ডার ভ্রমণ সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর সঞ্জয় ডাং আবার বলছেন, ‘‘পরশু রাতেই একটি পরিবারের জন্য ১৪টি ঘর সংরক্ষণ করেছিলাম পহেলগাঁওয়ে। পারিবারিক ছুটি কাটাতে তাঁরা সেখানে যাবেন বলেছিলেন। তাঁদের মায়ের ৭৫তম জন্মদিন উদ্যাপন করবেন বলে। ওই ভদ্রমহিলা ছোটবেলায় কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তার পর থেকে বিশ্বের বহু জায়গায় ঘুরে ফেললেও তিনি কাশ্মীরে যাওয়ার কথা বলেন। তাই মায়ের জন্মদিনে তাঁকে কাশ্মীরে নিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন ছেলেমেয়েরা। মঙ্গলবার রাতে ওঁরা ফোন করে জানালেন, তাঁরা যাচ্ছেন না।’’
ময়াল জানাচ্ছেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে ভারতের যে সমস্ত পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণার্থীদের ভিড় সবচেয়ে বেড়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল কাশ্মীর। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই ছবিটা বদলে গেল। মঙ্গলবারের ঘটনার পর পর্যটকদের কাছে কাশ্মীর এখন ভয়ের জায়গা। উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকে জঙ্গি কার্যকলাপের ভয়ে কাশ্মীর যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন পর্যটকেরা। সেই ছবিটা বদলেছিল গত কয়েক বছরে। ভয় কাটিয়ে কাশ্মীরে যাচ্ছিলেন পর্যটকেরা। পহেলগাঁওয়ের ঘটনায় কি পর্যটকদের সেই পুরনো ভয় আবার চেপে বসবে? আপাতত ভ্রমণ সংস্থাগুলির বক্তব্যে যা বোঝা যাচ্ছে, ভয় ছড়িয়েছে। কিন্তু সেই ভয় কত দিন স্থায়ী হবে, তা আপাতত পরবর্তী পরিস্থিতি এবং সময়ই বলতে পারবে।
- সংঘর্ষবিরতিতে রাজি ভারত এবং পাকিস্তান। গত ১০ মে প্রথম এই বিষয় জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে দুই দেশের সরকারের তরফেও সংঘর্ষবিরতির কথা জানানো হয়।
- সংঘর্ষবিরতি ঘোষণার পরেও ১০ মে রাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পাল্টা জবাব দেয় ভারতও। ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। তবে ১১ মে সকাল থেকে ভারত-পাক সীমান্তবর্তী এলাকার ছবি পাল্টেছে।
-
ভারতের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের পরিকল্পনা ছিল কি? সংঘর্ষবিরতির ৬৩ দিন পরে কী উত্তর দিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী
-
পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে সিন্ধুর উপনদে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ, বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ চাইল ভারত
-
‘ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি’! ভারতের ব্রহ্মস হানা নিয়ে নিজেদের শঙ্কার কথা প্রকাশ করলেন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা
-
পহেলগাঁও কাণ্ডের পরে ‘কোপ’ পড়েছিল, সেই সব পাকিস্তানি ইউটিউব চ্যানেল, ইনস্টাগ্রামের উপর থেকে সরছে নিষেধাজ্ঞা
-
সিন্ধু চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পর পর চিঠি, ভারত কি অবস্থান বদলাবে? উত্তর দিলেন জলশক্তিমন্ত্রী