Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ছাদ-বাগান আর শাক-আনাজে সংস্কৃতি বাঁচানোর আর্জি

এমন আটপৌরে মেয়েলি গল্প নিয়ে সচরাচর কথা হয় না বিদগ্ধ মহলে। স্নিগ্ধ, হাস্যোজ্জ্বল এক বিদেশিনি এসে সেই গল্পের হাট খুলে বসলেন কলকাতা বইমেলায়।

বক্তা: ‘অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতা’ দিচ্ছেন এউদা মোরালেস। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

বক্তা: ‘অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতা’ দিচ্ছেন এউদা মোরালেস। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:২৫
Share: Save:

এমন আটপৌরে মেয়েলি গল্প নিয়ে সচরাচর কথা হয় না বিদগ্ধ মহলে। স্নিগ্ধ, হাস্যোজ্জ্বল এক বিদেশিনি এসে সেই গল্পের হাট খুলে বসলেন কলকাতা বইমেলায়।

বিজাতীয় উচ্চারণ, খটোমটো নামের আড়ালে থাকা শাক-আনাজের গল্প। হয়তো বা হারিয়ে যাওয়া এক গেরস্থালি, পরিবারেরও গল্প। স্প্যানিশে অদীক্ষিত বাঙালি সুদূর ল্যাটিন আমেরিকায় মায়া সভ্যতার দেশ গুয়াতেমালার পাড়াগাঁর গল্প শুনছিল ইংরেজির হাত ধরে। এবং একই সঙ্গে অদৃশ্য আয়নায় নিজেকেও খানিকটা দেখছিল নিশ্চয়।

শুক্রবার বিকেলে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার গুয়াতেমালা প্যাভিলিয়নে ‘অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতা’ দিচ্ছিলেন এউদা মোরালেস। তাঁর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টিবিদ্যার পণ্ডিত তিনি। কিন্তু সাহিত্য, ইতিহাস আর সংস্কৃতির সঙ্গে রান্নাঘরকে দক্ষ হাতে মিলিয়ে দিয়েছেন এই মধ্যবয়সিনি।

সাংস্কৃতিক চিহ্নের খোঁজে স্প্যানিশভাষী মহিলা নিরন্তর ঘুরে চলেছেন তাঁর দেশের গ্রামে গ্রামে। সেখানে অনেকেই তাঁর ভাষা বোঝেন না। তাঁদের কাছ থেকে সাবেক রান্নার পদের খোঁজ করছিলেন এউদা। পেয়েওছেন কিছু কিছু। আবার একই সঙ্গে দেখেছেন, আদিম মায়া ভাষার জবানি আঁকড়ে ধরে থাকলেও বিচিত্র জনজাতির মা-দিদিমারা কিন্তু সাবেক রান্নাশৈলী, পারিবরিক অমূল্য ‘রেসিপি’ সব হারাতে বসেছেন। ‘চার্দ’ নামের এক ধরনের সতেজ সবুজ শাকের গল্প উঠে এল এই প্রসঙ্গেই।

এউদা বলছিলেন, গুয়াতেমালার চিমালতেনানঙ্গো প্রদেশের মফস্‌সল শহর সান্তাক্রুস বালানিয়ার কথা। ‘‘আমি তো অবাক! গ্রামের মেয়েরা সব চার্দ রাঁধতে জানে না বলে এমন পুষ্টিকর স্বাদু শাক সবটা বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। তার বদলে বাচ্চাদের নরম পানীয় কিনে দিচ্ছেন তাঁরা।’’ এমন অনেক গ্রামেই ঘুরে ঘুরে হারানো রান্না শিখিয়ে বেড়াচ্ছেন এউদা। গুয়াতেমালার রন্ধন-সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রদূতের গবেষণার সূত্রে উঠে এসেছে কঠিন সব সামাজিক বাস্তবতা। শহরের মেয়েদের মধ্যে সমীক্ষা করে তিনি দেখেছেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ তাজা আনাজের বাজারে না-গিয়ে সপ্তাহে এক বার শপিং মলে বাজারে বিশ্বাসী। টিনের খাবারের উপরে নির্ভরতা বাড়ছে। পাড়াগাঁয়ের দিকে ছবিটা সৌভাগ্যবশত একটু আলাদা। সেখানে তুলনায় মানুষের হাতে সময় বেশি। এউদা বললেন, ‘‘মানুষের হাতে রাঁধাবাড়া, খাওয়ার সময় কমে আসছে। পেশাগত ব্যস্ততার রোজনামচায় সময়াভাবই আমাদের রান্না-খাওয়ার সময় বেঁধে দিচ্ছে।’’

তবু সাবেক শাক-আনাজেই তো যে-কোনও দেশের ইতিহাসের চিহ্ন। দুনিয়া জুড়ে ইদানীং ‘লোকাভোর’ (স্থানীয় খাবার) আন্দোলন খুব জনপ্রিয়, যা স্থানীয় আনাজ-মাছ-মাংসই খেতে বলে। নাম না-করে খানিকটা সে-কথাও মনে করিয়ে দিলেন এউদা। বরং এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘‘পুরনো রেসিপি বা রান্না-প্রণালীতেই ব্যক্তি, পরিবার, দেশের সাংস্কৃতিক চিহ্ন থাকে।’’ কিন্তু তিনি স্পষ্টতই হতাশ, বিপণনের ঢক্কানিনাদ, সোশ্যাল মিডিয়ার উস্কানি ক্রমশ সাবেক ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিচ্ছে মানুষকে। খাবারের রেসিপিগুলো বাঁচিয়ে রাখা তাই আজকের দিনে এক ধরনের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।’’

একেলে নাগরিক জীবনে তিনটি দাওয়াই বাতলে গিয়েছেন মায়া সভ্যতার নারী। ছাদে, বারান্দায় একটা বাগান করুন। স্থানীয় আনাজ, মরসুমি ফলের মহিমা বুঝুন। খাবারের শিল্পায়নের সঙ্গে লড়তে পারিবারিক রন্ধন-প্রণালী বাঁচিয়ে রাখুন!

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সেই চেনা, কিন্তু বিস্মৃত বাড়িরই গল্প বলছেন বুঝি বিদেশিনি। নীরেন চক্রবর্তীর ‘পুকুর মরাই, সব্জি বাগান, জংলা ডুরে শাড়ি’ জেগে উঠছে চার পাশের কাঠখোট্টা নাগরিকতায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE