১৯৯০ সালে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। ছবিটি পাহাড়ী রায়চৌধুরীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
মহাশ্বেতা দেবীর লেখার টেবিল কখনও বদলায়নি। বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে জ্যোতির্ময় বসুর বাড়িতে লোহার ঘোরানো সিঁড়িওয়ালা ছাদের ঘর, গল্ফ গ্রিন বা রাজডাঙা যেখানেই থাকুন না কেন, টেবিলটি সর্বদা অগোছালো। গাদাগুচ্ছের খাম, আবেদনপত্র, সরকারি লেফাফা, সম্পাদিত ‘বর্তিকা’ পত্রিকার প্রুফ-কপি ছড়িয়েছিটিয়ে। এক পাশে কোনও ক্রমে তাঁর নিজস্ব রাইটিং প্যাড ও কলমের সকুণ্ঠ উপস্থিতি। সাদা বড় সেই চৌকো প্যাডে ডট পেনে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাই তাঁর অভ্যাস।
লেখা মানে, সাহিত্য অনেক পরে। কোন শবর গ্রামে টিউবওয়েল বসেনি, ব্যাঙ্ক কোন লোধা যুবককে ঋণ দিতে অস্বীকার করেছে— সরকারি দফতরে ক্রমাগত চিঠি লেখাই যেন তাঁর প্রথম কাজ। জ্ঞানপীঠ থেকে ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত মহাশ্বেতা যতখানি লেখক, ততখানিই অ্যাক্টিভিস্ট। ৮৮ বছর বয়সেও নিজের হাতে ইনসুলিন ইঞ্জেকশনের ছুঁচ ফোটাতে ফোটাতে যিনি বলতেন, ‘‘তোমরা যাকে কাজ বলো, তার চেয়ে এ সব অকাজে আমার উৎসাহ বেশি।’’
আরও খবর-‘আমার বর্তিকায় লেখো’! রিকশাওয়ালা মদন সেই থেকে লেখক হয়ে গেলাম
একটিমাত্র অভিধায় মহাশ্বেতাকে ধরা তাই অসম্ভব। তিনি ‘হাজার চুরাশির মা’। ‘অরণ্যের অধিকার’-এর সেই প্রবাদপ্রতিম লাইন ‘উলগুলানের মরণ নাই’-এর জননী। অন্য দিকে তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম মুখ। এক দিকে তাঁর লেখায় বিহার-মধ্যপ্রদেশের কুর্মি, দুসাদ, ভাঙ্গিরা সজোরে বাঙালি পাঠকের দরজায় ঘা দেয়। আর এক মহাশ্বেতা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে দিল্লি বোর্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আনন্দপাঠ’ নামে সঙ্কলন তৈরি করেন, জিম করবেট থেকে লু স্যুন, ভেরিয়ের এলউইনকে নিয়ে আসেন বাংলা অনুবাদে। তাঁর বাড়িতে গ্রাম থেকে আসা হতদরিদ্র মানুষের নিত্য আনাগোনা।
বছর দুয়েক আগের কথা। কোনও কাজে কলকাতায় এসে এক শবর যুবক আস্তানা নিয়েছেন মহাশ্বেতার বাড়িতে। স্নান সেরে বেরিয়ে তাকের উপরে রাখা মহাশ্বেতার চিরুনি দিয়েই ঘসঘস করে চুল আঁচড়ালেন। জাতপাতহীন, শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন এ শহরে অনেক বামপন্থীই দেখে থাকেন। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত তেল-সাবান চিরুনি অন্যকে ক’জন অক্লেশে ব্যবহার করতে দিতে পারেন? কী ভাবে এল এই অনায়াস আপনাত্তি? ২০০১ সালে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে বলেছিলেন মহাশ্বেতা, ‘যখন শবরদের কাছে গেলাম, আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল। আদিবাসীদের নিয়ে যা কিছু লিখেছি, ওদের মধ্যেই তা খুঁজে পেলাম।’
আরও খবর- সব মরণ নয় সমান
নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগেই তো মহাশ্বেতার লেখায় উঠে আসছিল অশ্রুত সব স্বর। ১৯৬৬ সালে বেরিয়েছিল ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু।’ সেখানে ঔপন্যাসিকের স্বীকারোক্তি: ‘অনেক দিন ধরেই ইতিহাসের রোমান্স আমাকে আর আকর্ষণ করছিল না। এমন এক যুবকের কথা লিখতে চেয়েছি যে তার জন্ম ও জীবনকে অতিক্রম করে নিজের জন্য একটি জগৎ তৈরি করতে চেয়েছিল, যে জগৎ তার নিজের সৃষ্ট।’ ‘চোট্টি মুণ্ডা ও তার তীর’-এও সেই অবিনশ্বর স্পিরিট: ‘চোট্টি দাঁড়িয়ে থাকে। নিরস্ত্র। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে চিরকালের সঙ্গে মিলেমিশে হয়ে যায় নদী, কিংবদন্তী। একমাত্র মানুষই যা হতে পারে।’ এই প্রান্তিক জীবনের কাহিনিকার হিসেবেই মহাশ্বেতা পরিচিত হবেন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বিদ্বৎসমাজে। গায়ত্রী
চক্রবর্তী স্পিভাক ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন মহাশ্বেতার লেখা। মহাশ্বেতাকে তাই দেখতে হবে বাংলা ছাড়িয়ে, ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে।
আন্তর্জাতিক মননের সঙ্গে মহাশ্বেতার পরিচয় অবশ্য জন্ম থেকেই। বাবা: কল্লোল যুগের বিখ্যাত লেখক যুবনাশ্ব বা মণীশ ঘটক। কাকা: ঋত্বিক ঘটক। বড়মামা: অর্থনীতিবিদ, ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা শচীন চৌধুরী। মায়ের মামাতো ভাই: কবি অমিয় চক্রবর্তী। ক্লাস ফাইভ থেকে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাংলার ক্লাস নেন, নন্দলাল বসু ও রামকিঙ্কর বেইজকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া যায়। সময়টাও নজর করার মতো। ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের পাবনা (অধুনা রাজশাহি) জেলার নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে মহাশ্বেতার জন্ম। ঠিক তার পরের বছরই জন্মাবেন ‘আগ কি দরিয়া’র লেখক কুরাতুলিন হায়দার। দু’জনের লেখাতেই মহাকাব্যিক বিস্তারে উঠে আসবে জাতপাত, পিতৃতন্ত্র। মহাকাব্যিক চেতনা থেকেই তো ‘স্তনদায়িনী’র নাম যশোদা। থানায় ধর্ষিতা দোপদী মেঝেন দ্রৌপদীরই আধুনিক সংস্করণ। ভারতীয় নিম্নবর্গ যে স্থবির অচলায়তন নয়, সেখানেও আছে খাড়াখাড়ি বিভাজন— তাও কি ধরা পড়েনি ‘শ্রীশ্রীগণেশমহিমা’য়: ‘‘ভাঙ্গিদের হোলির পরব শেষ হয় দু’টি শুয়োর মেরে, মদেমাংসে সারা রাত হল্লা করে। দুসাদরা এখানে ছিন্নমূল। ফলে বছর দুয়েক হল, তারাও ভাঙ্গিদের সঙ্গে হোলির দিনে মাখোমাখো করে।’’
আরও খবর- মহাশ্বেতা-স্মরণে: হাইলাকান্দি আপনার স্মৃতিচারণায় গর্বিত
সাহিত্যযাত্রার এই মোড়ে একদিনে এসে দাঁড়াননি মহাশ্বেতা। তার পিছনে ছিল দীর্ঘ পরিক্রমা। ’৪৬-এ বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজির স্নাতক। এমএ পাশ করে বিজয়গড়ে জ্যোতিষ রায় কলেজে পড়ানো। তার আগে ১৯৩৯ সাল থেকেই ‘রংমশাল’ কাগজে ছোটদের জন্য লেখালেখি শুরু। স্বাধীনতার বছরে ‘নবান্নে’র রূপকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে। সে সময়টা কখনও সংসার চালাচ্ছেন টিউশনি করে, কখনও সাবানগুঁড়ো বিক্রি করে। মাঝে এক বার আমেরিকায় বাঁদর চালান দেওয়ার পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন, সফল হয়ে উঠতে পারেননি। ১৯৬২’তে বিবাহবিচ্ছেদ, পরে অসিত গুপ্তের সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ। ১৯৭৬ সালে সেই দাম্পত্যেরও অবসান ঘটে।
ইতিমধ্যে, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি একমাত্র পুত্র নবারুণকে বাবার কাছে রেখে, চেয়েচিন্তে একটা ক্যামেরা জোগাড় করে উঠে পড়েছিলেন আগরার ট্রেনে। তন্নতন্ন করে রানির কেল্লা, মহালক্ষ্মী মন্দিরে ঘুরলেন। সন্ধ্যার অন্ধকারে টাঙাওয়ালা, কাঠকুটোর আগুন ঘিরে বসা কিষাণ মেয়েদের থেকে গল্প শুনলেন, ‘রানি মরেনননি। বুন্দেলখণ্ডের মাটি আর পাহাড় আজও ওঁকে লুকিয়ে রেখেছে।’
আরও খবর- স্মৃতির পাতায় মহাশ্বেতা
এর পরেই ‘ঝাঁসির রানী’ উপন্যাস ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে বেরোল এবং একা একা ঘুরে বেড়িয়ে লেখার উপাদান সংগ্রহ করার বিপ্লবিয়ানায় মহাশ্বেতা তাঁর পূর্বসুরি লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণাদের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা হয়ে গেলেন। আলাদা হয়ে গেলেন তাঁর অকুণ্ঠ রাজনৈতিক উচ্চারণেও। ‘অগ্নিগর্ভ’ উপন্যাসের সেই মোক্ষম লাইন: ‘জাতিভেদের সমস্যা ঘুচল না। তৃষ্ণার জল ও ক্ষুধার অন্ন হয়ে রইল রূপকথা। তবু কত দল, কত আদর্শ, সবাই সবাইকে বলে কমরেড।’ কমরেডরা তো কোনও দিনই ‘রুদালি’, ‘মার্ডারারের মা’-এর সমস্যা দেখেননি। ‘চোলি কে পিছে’ গল্পের স্তনহীন নায়িকা যে ভাবে ‘লক আপে গ্যাংরেপ… ঠেকেদার গাহক করে, গানা বাজায়’ বলে চেঁচাতে থাকে, পাঠকেরও কানে তালা লাগে।
সব মিলিয়ে মহাশ্বেতা যেন প্রিজমের মতো। কোনও দিন রুক্ষভাষী, কোনও দিন আড্ডা না মেরে ছাড়বেনই না। শেষ দিকে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা, পুত্রশোক অনেকটাই ধ্বস্ত করে দিয়েছিল। তবু মহাশ্বেতাই কি হয়ে থাকলেন রাজনীতিসঞ্জাত বহুমুখী বাঙালির শেষ উত্তরাধিকার? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভামঞ্চে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। মহাশ্বেতা পাত্তা দেননি। লোকের কথায় পাত্তা দেওয়ার অভ্যাসটি কোনও দিনই তাঁর করায়ত্ত ছিল না।
সুষমার ভুল
মহাশ্বেতা দেবীর প্রয়াণে শোকবার্তা জানিয়ে টুইট করে বিতর্কে জড়ালেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলায় সুষমা টুইটে লেখেন, ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ এবং ‘বকুল কথা’ বই দু’টি তাঁকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল।
অথচ বই দু’টির কোনওটিই মহাশ্বেতার লেখা নয়। আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন সুষমা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy