১০০ দিনের প্রকল্পে খালের মাটি কেটে ফেলা হচ্ছে অবৈধ মেছো ঘেরির সীমানা প্রাচীরে, অভিযোগ বিজেপির। হাসনাবাদের খাঁপুকুর গ্রামে। ছবি: নির্মল বসু
‘আমপান’-এর সময়ে যে খাল দিয়ে ঢুকে আসা নোনা জল তাঁদের খেত ভাসিয়েছিল, এখন শুকনো সে খাল কেটে গভীর করছেন তাপস রায়, বিশ্বনাথ মণ্ডলেরা। কাটা মাটি দীপালি পাত্র, অসীমা মণ্ডলেরা ঝুড়ি করে ফেলছেন ‘বাঁধে’। আপাতদৃষ্টিতে, ‘রুটিন’ ১০০ দিন কাজের প্রকল্প। কিন্তু বিজেপির অভিযোগ, এ ‘বাঁধ’, সে বাঁধ নয়। আসলে তা ‘অবৈধ’ মেছো ঘেরির সীমানা-প্রাচীর। আমপানের ক্ষতিপূরণ উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদের গ্রামে যাঁদের দিতে পারেননি স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব, সরকারি টাকায় তাঁদের কাজ করিয়ে ঘেরির সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে।
অবৈধ ঘেরির কথা মানেনি প্রশাসন। বিজেপির অভিযোগ না মানলেও, চোখে না দেখে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি বসিরহাট উত্তরের (হাসনাবাদ এই বিধানসভায় পড়ে) বিদায়ী বিধায়ক, সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া রফিকুল ইসলাম।
হাসনাবাদ পঞ্চায়েতের খাঁপুকুর গ্রামের ১৩ নম্বর সংসদ এলাকায় শ’তিনেক পরিবারের বাস। ঝড়ে বাড়ি ভাঙা বা চাষজমির ক্ষতি হওয়ার পরেও ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে মাটি কাটতে আসা মিলন মণ্ডল, জয়ন্তী হালদারদের। কাজের তদারকিতে ব্যস্ত ছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়ত সদস্যা সীমা মণ্ডলের স্বামী তথা এলাকার তৃণমূল নেতা দীপক মণ্ডল। তাঁর দাবি, ‘‘কারও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সমস্যা, কারও আস্তানা সরকারি জমিতে, একটি যৌথ পরিবারের নামে ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও, সদস্যদের অনেকে আলাদা ভাবে টাকা চাইছেন—এমন হয়েছে। বহু চেষ্টাতেও গোটা ২৫ পরিবার এমন রয়েছে, যাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়নি। কিন্তু কাজ দিয়েছি প্রকল্পে।’’
মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ফুঁসে উঠেছিল ডাঁসা নদী। বাঁধ ভাঙায় কাঁটাখালি থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার খাল দিয়ে ঢোকে জল। ভাসায় চাষ-জমি। দীপকবাবু জানালেন, ১০০ দিনের প্রকল্পে ৫০ ফুট চওড়া সে খালের ৩৫ ফুট অংশে নাব্যতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। প্রায় ১০০ জন কাজ করছেন দৈনিক ২০৪ টাকা মাথাপিছু পারিশ্রমিকে। ওই এলাকায় একটি কালভার্ট দিয়ে আমপান-কালে জল ঢুকেছিল। কালভার্টের জায়গায় জল নিয়ন্ত্রণ করার একটি স্লুইস গেট চান তাঁরা। কিন্তু সে গেট না হওয়ার আগে খালের গভীরতা বাড়ালে, দুর্যোগে জমিতে আরও বেশি নোনা জল ঢোকার সম্ভাবনা বাড়বে না?
‘‘বাড়বে। তাতে লাভ হবে ‘ফিশারি’র (অবৈধ মৎস্য চাষ এ নামেই জনপ্রিয় এলাকায়),’’ বলছেন শ্রমিকদের একাংশ। তাঁদের ব্যাখ্যা, খালে বেশি জল মানে, অবৈধ ঘেরিতে ভেনেমাই বা বাগদা চিংড়ির চাষের জলের সুবিধে। আর যে মাটি ‘ফিশারি’র গায়ে ফেলা হচ্ছে, তাতে তার দেওয়াল পোক্ত হবে। খাল থেকে কাটা মাটি তো উল্টো দিকের রাস্তা পেরিয়েও রাখা যেতে পারত? দীপকবাবুর দাবি, সে সব ব্যক্তি-মালিকানার জমি। মাটি ফেললে আপত্তি হতে পারে।
১০০ দিনের প্রকল্পে যেখানে কাজ হচ্ছে, সেখান থেকে দূরে মাটি ফেলতে হলে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায় জানাচ্ছেন হাসনাবাদের বিডিও মোস্তাক আহমেদ। তবে তিনি বলেন, ‘‘কৃষি-সেচ সেন্সাস চলছে হাসনাবাদে। ব্লকের সব জলাশয়ের বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যা ব্যবস্থা হচ্ছে, কেউ অবৈধ ঘেরি চালাতে সাহস পাবে না।’’
স্থানীয় সূত্রের খবর, ‘ফিশারি’তে যে দু’-তিন জন চিংড়ির দেখভাল করেন প্রতি মরসুমে (ভেনেমাইয়ের জন্য সাড়ে তিন মাস, বাগদার জন্য ছ’মাস) মাসে খাওয়াদাওয়া-সহ ১২ হাজার টাকা রোজগার তাঁদের। এ ছাড়া, প্রতি ফিশারিতে বিভিন্ন দায়িত্বে আরও ২৫-৩০ জন কাজ করেন। ফলে, জনতার একাংশের সমর্থন সদাই রয়েছে এ ব্যবসায়। গত সাত-আট বছরের মধ্যে হাসনাবাদের ঘুনি, টিয়ামারি, বাইলানি এলাকায় এবং হিঙ্গলগঞ্জের হেমননগর, মঙ্গলচণ্ডী, খলসেখালি এবং সর্দারপাড়ায় অবৈধ ঘেরি হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় সূত্রের।
বিজেপির বসিরহাট সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তারক ঘোষের অভিযোগ, ‘‘আমপানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বেআইনি পথে কিছু লোককে টাকা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করছে তৃণমূল। যে সব বাঁধ আমপানে ভেঙেছে, তার অনেকগুলোর পিছনেই তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের একাংশ দায়ী। কারণ, ঘেরি এবং ইটভাটার স্বার্থে ওঁরা মাটি কাটায় মদত দেন। তাতে বাঁধ দুর্বল হয়। প্রশাসনকে অভিযোগ জানিয়েছি।’’
এলাকায় বাঁধ কেন ভেঙেছিল তা জানেন না বলে দাবি আমপান-ইস্তক পশ্চিম ঘুনি এলাকায় বাঁধের ধার ঘেঁষে অস্থায়ী ঝুপড়িতে কাটানো জয়ন্তী কয়ালের। জানালেন, সরকারি ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। ঘর এখনও গড়া হয়নি।
এলাকার বিদায়ী বিধায়ক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘হাসনাবাদ পঞ্চায়েত এলাকায় কী হয়েছে না দেখে, মন্তব্য করা যাবে না। তবে ওই এলাকায় ত্রাণ এবং ক্ষতিপূরণ যতটা সম্ভব, দেওয়া হয়েছে।’’ হিঙ্গলগঞ্জের বিদায়ী বিধায়ক তৃণমূলের দেবেশ মণ্ডলের দাবি, ‘‘আমপানের ত্রাণ বিলিতে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি হয়নি। বরং, বিজেপি রাজনৈতিক কারণে যে পরিবার ত্রাণ-সাহায্য পেয়েছে তাদেরই এক জনকে ফের ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’’ বিজেপি সে অভিযোগ মানেনি।
দেবেশবাবুর এলাকার প্রান্তসীমায় থাকেন ৬৮ বছরের বিমল রফতান। বাড়ি সুন্দরবনের গা ছোঁয়া ৪ নম্বর শামসেরনগরে, কুড়েখালি নদী-বাঁধের ধারে। দিন চলে কাঁকড়া-চিংড়ি ধরে। এলাকায় পরিচিত পুরনো বাম সমর্থক হিসেবে। বলেছেন, ‘‘আমপানের জন্য বাড়ির ক্ষতি হয়েছিল। আমি না পেলেও ছোট ছেলে ২০ হাজার টাকা পেয়েছে। সরকার দিয়েছে। অস্বীকার করা যাবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy