Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

টানাপড়েনে চোখের জল শুকোয় পুত্রহারার

গোপীবল্লভপুরের প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে জোয়ালডাঙা গ্রাম। ভোরবেলায় যেতে গিয়েও বাধা গেলাম সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্দীপ করণের ফোনে, ‘‘সাড়ে সাতটার পর আসুন। গতকালও হাতি বেরিয়েছিল।’’

হাতির হানায় মৃত শ্যামাপদর বাবা বাদল মল্লিক। —নিজস্ব চিত্র।

হাতির হানায় মৃত শ্যামাপদর বাবা বাদল মল্লিক। —নিজস্ব চিত্র।

গৌতম চক্রবর্তী
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ০২:৩০
Share: Save:

মোদী-মমতা দ্বৈরথ নয়। যৌথবাহিনী, ইভিএমও নয়। হাতি এবং নেকড়ে বাঘই এই গ্রীষ্মে ঝাড়গ্রামের জঙ্গল-লাগোয়া গ্রামগুলিতে আসল সমস্যা।

বৈশাখের এক দ্বিপ্রহরে গোপীবল্লভপুরের বাছুরখোঁয়াড় গ্রামে লোকেরা দুঃখ করছিলেন, দু’ দিন আগেই হাতি এসেছিল। ঘর ভেঙেছে এবং এক-দেড় বিঘা জমিতে পাকা ধান খেয়ে গিয়েছে সেই যূথপতিরা।

গোপীবল্লভপুরের প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে জোয়ালডাঙা গ্রাম। ভোরবেলায় যেতে গিয়েও বাধা গেলাম সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্দীপ করণের ফোনে, ‘‘সাড়ে সাতটার পর আসুন। গতকালও হাতি বেরিয়েছিল।’’

নির্বিচারে জঙ্গল কাটলে, খাবার কমে গেলে এই শুখা গ্রীষ্মে হাতি গ্রামে আসবে, সেটা নতুন কথা নয়। কিন্তু ওই গ্রামেই দেখা হল শীর্ণ চেহারার প্রৌঢ় বাদল মল্লিকের সঙ্গে। বাদলবাবুর ছেলে শ্যামাপদ মার্চ মাসের ভোরে স্ত্রীকে নিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিল মহুল ফুল কুড়োতে। ওই ফুল থেকে মহুয়া তৈরি হবে, শুকনো ফল বাজারে বেচাও যাবে। মহুলের খোঁজে জঙ্গলের দু’ তিন কিমি ভিতরে এ ভাবে অনেকেই চলে যায়।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কিন্তু গ্রামে ফেরার পথে সে দিন ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে দুটি হাতি। স্ত্রী ছুটে পালান, শ্যামাপদ হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। একটি হাতি এসে তাঁর বুকে পা তুলে দেয়।

গ্রামের লোকে খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে যায়। শ্যামাপদকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। তাঁরা মেদিনীপুরে কেসটি রেফার করে দেন। সেখানে মেডিক্যাল কলেজ আছে। তাঁরা আবার কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে কেসটি পাঠাতে চান, গ্রামের গরিব মানুষগুলি ভয়ার্ত বোবাকান্নায় নীরব হয়ে যান। কলকাতা, সেখানে তাঁরা কাউকে চেনেন না। এসএসকেএমটাই বা কোন দিকে? সেখানকার ডাক্তারবাবুরা গ্রাম থেকে যাওয়া রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে আদৌ কথা বলেন? গ্রামের লোকের আপত্তির কারণে শ্যামাপদকে মেদিনীপুরেই রাখা হয়।

সে দিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানালেন, সকাল ছটায় পাঁজরে ‘মাল্টিপল ফ্র্যাকচার’ নিয়ে শ্যামাপদকে মেদিনীপুরে ভর্তি করা হয়, কিন্তু রাত ন’টা অবধি রক্ত ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবা পায়নি সে।

শ্যামাপদ বাঁচেননি। ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে সে সুপার স্পেশ্যালিটির তোয়াক্কা না করে, বৃদ্ধ বাবার ঘাড়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানের ভার চাপিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো মারা যায়। হাতির আক্রমণে মারা গেলে বন দফতর থেকে ক্ষতিপূরণ পাওযার কথা। বন দফতরের বক্তব্য, হাসপাতাল ডেথ সার্টিফিকেটে লিখে দিক, হাতির হানায় মৃত্যু। হাসপাতালের জবাব, তাহলে পোস্ট মর্টেম করে রিপোর্ট দিতে হবে। দুই দফতরের আমলাতান্ত্রিক টানাপড়েনে নিরক্ষর বৃদ্ধ বাবার চোখের জল শুকিয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি, শয্যায় লাগানো বেড টিকেট সব জায়গায় হাতির হানা উল্লেখ থাকলেও পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে নেই। মায় ডেথ সার্টিফিকেট হাতে পেতে এখনও কয়েক দিন লাগবে। গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষতিপূরণ-টুরণ অনেক নীতিই থাকে। কিন্তু গরিবের প্রতি সমানুভূতি ছাড়া সেই সব নীতি যে আদতে সামাজিক ন্যায় ও ন্যায্যতার সন্ধান দিতে পারে না, বাবুদের খেয়াল থাকে না।

জোয়ালডাঙার প্রাথমিক স্কুলটি যেমন। চতুর্থ শ্রেণি অবধি। ক্লাস এইট অবধি রাখার লক্ষ্যে নতুন একটি বাড়ি তোলা হয়েছে, কিন্তু এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। সন্দীপ জানালেন, প্রাথমিকের পর তাই হাতি-অধ্যুষিত জঙ্গলের রাস্তায় রোজ সাত কিমি সাইকেল চালিয়ে বাচ্চাদের ঝাড়গ্রাম যেতে হয়। আর একটু অগিয়ে শোলগেড়িয়া গ্রামে নলকূপ খারাপ। পঞ্চায়েত অফিসের পাশে খোলা পাতকুয়োর জলেই তৃষ্ণা নিবারণ! গ্রামের অনেকে প্রধানমন্ত্রীর উজালা প্রকল্পে রান্নার গ্যাস পেয়েছেন। কিন্তু রান্নাবান্নার জন্য আজও জঙ্গলের কাঠকুটো, শুকনো ঢাঁটিজঙ্গলের পাতাই ভরসা। ‘‘গ্যাসের দাম ৯০০ টাকা। দেবে কে?’’ হাসলেন সন্তোষ মাহাতো। জঙ্গল থেকে কামরাজ ও অন্যান্য গাছের জড়িবুটি এনে তিনি হাতুড়ে চিকিৎসা করেন।

এটাই জীবন। ঝাড়গ্রাম এবং জঙ্গলমহল মানে স্রেফ মাওবাদ বনাম উন্নয়নের ‘রেটরিক’ নয়। শীতের মহুয়ামত্ত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ও নয়। বরং আমাদের শহুরে জীবনের চেনা ছকের আড়ালে চাপা পড়ে-যাওযা আরও অনেক কিছু।

গোপীবল্লভপুর থেকে ওড়িশার দিকে যাওযার পথেই খড়িকামাথানি চক। সেখানে আছে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। ভরদুপুরে সেখানকার আউটডোর জনশূন্য, কাঠের বেঞ্চে এক জন লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছেন। ডাক্তারবাবু সকালে না এসে দেরি করে দুপুরের দিকে এসেছেন, এক গ্রাম্য দম্পতি তাঁর প্রেসক্রিপশন হাতে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুপুর দুটো বাজেনি, তবু ন্যায্য মূল্যের ওষুধের কাউন্টারটি বন্ধ। আউটডোরে লাগানো বোর্ড দেখে বোঝা গেল, এই সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে হৃদরোগ বা কিডনির স্পেশালিস্ট ডাক্তার নেই। গ্রামের এক জন বললেন, অসুখবিসুখে হাতুড়ে ভরসা। নইলে গাড়ি ভাড়া করে ঝাড়গ্রাম বা মেদিনীপুর। সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স সাতশো টাকা নেয়, চার চাকার প্রাইভেট গাড়ি ৫০০ টাকা।

তা হলে লোকে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে চেঁচায় না কেন? ওটা রাজনীতিবিদদের কাজ। গ্রামের এক জন বললেন, ‘এখানকার সুপার স্পেশ্যালিটিটা খারাপ, মেদিনীপুরেরটা ভাল।’ জনসমাজ নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই এই সব হাসপাতালের কোনটা উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ, কোনটা নিচু থাকের ঠিক করে নিয়েছে।
এই জাতপাত কোথায় নেই? গোপীবল্লভপুরের এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে, জঙ্গল পেরিয়ে একটু ভিতরে ঢুকে এলে নকশাল আমলের বিপ্লবী সন্তোষ রাণার পিতানাউ গ্রাম। সেই সন্তোষবাবুও তাঁর আত্মজীবনীতে দুঃখ করেছেন, আন্দোলনের সময়েও এখানে এক জন মাল যুবক দশ কিলোমিটার দূরে আর-একটা মাল গ্রামে যোগাযোগ করার ব্যাপারে স্বচ্ছন্দ ছিল। কিন্তু তার পাশে তেলি বা অন্য জাতির গরিব কৃষকের সঙ্গে নয়।

সেই অসাম্য আজও! কথা হচ্ছিল সন্তোষবাবুর ভাই, প্রতীচী ট্রাস্টের কুমার রাণার সঙ্গে। তাঁর মনে আছে, ছেলেবেলায় বাড়িতে ফাতু মান্ডি নামে এক আদিবাসী মজুর ছিলেন। গরিব, রোজ খাবার জুটত না। এখন গ্রামের বহু বাড়িতে মোটরসাইকেল, পাওয়ার টিলার। কিন্তু ফাতু ভাঙা বাড়ি সারাতে পারেননি, গরুর বাগালি করেন। ‘‘অন্যরা যদি উন্নতিতে কয়েক মাইল এগিয়ে যান, ফাতুর মতো আদিবাসীরা এগিয়েছেন এক বিঘত,’’ বললেন কুমারবাবু। ভোটে মমতা না মোদী, সেটা বড় প্রশ্ন নয়। ওই অসাম্য ঘুচবে কী ভাবে, সেটাই আসল জিজ্ঞাসা।

পিতানাউয়ের অদূরে, বাছুরখোঁয়াড় গ্রামের কাছেই রামেশ্বর শিব মন্দির। তার একটু আগে তপোবন নামে এক জঙ্গল। আর ডুলুং নদী থেকে বেরনো এক চিলতে সীতানালা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, সীতা এই খাল পেরিয়েই তপোবনে গিয়েছিলেন। জঙ্গলমহল বুঝিয়ে দেয়, এই দেশে রামচন্দ্র মানে শুধু অযোধ্যা নয়, তিন শতাধিক রামায়ণ এবং ছোট ছোট স্থানীয় কিংবদন্তি। ক্ষমতার রাজনীতি তার খেয়াল রাখে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Junglemahal Jhargram Elephant Forest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE