Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ঠুঁটো কমিশনে কাজ কী

১৮ই ফোঁস করলেও ফের ভোট করাতে ব্যর্থ

কলকাতা পুরভোট যে যথাযথ বা ‘আইডিয়াল’ পরিবেশে হয়নি, সে কথা ভোটের দিনই নিজের মুখে কবুল করেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। অথচ তিন দিন পরে সেই তিনিই জানিয়ে দিলেন, কোনও বুথেই পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না। কেন? সুশান্তবাবু মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, বিরোধীরা ৩০টি বুথে পুনর্নির্বাচন চেয়েছিলেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

কলকাতা পুরভোট যে যথাযথ বা ‘আইডিয়াল’ পরিবেশে হয়নি, সে কথা ভোটের দিনই নিজের মুখে কবুল করেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। অথচ তিন দিন পরে সেই তিনিই জানিয়ে দিলেন, কোনও বুথেই পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না।

কেন?

সুশান্তবাবু মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, বিরোধীরা ৩০টি বুথে পুনর্নির্বাচন চেয়েছিলেন। কিন্তু মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসার তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের যে রিপোর্ট তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছে, তাতে বলা হয়েছে, ভোটের দিন কোনও বুথেই গোলমাল হয়নি। কোথাও ভোটগ্রহণ ব্যাহত হয়নি। সর্বত্রই অবাধে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। সুশান্তরঞ্জন দাবি করছেন, রিটার্নিং অফিসারের রিপোর্টকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাঁর নেই। তাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওই রিপোর্ট অবাস্তব মনে হলেও, একতরফা পুনর্নির্বাচন ঘোষণা করতে পারছেন না তিনি।

বিরোধীরা এখন প্রশ্ন তুলছেন, রিটার্নিং অফিসার যদি বলেন যে কোথাও কোনও গোলমাল হয়নি, তা হলে ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনার কীসের ভিত্তিতে ভোটগ্রহণের পরিবেশ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন? নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের কারও কারও মৌখিক রিপোর্ট এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরের ভিত্তিতেই সে দিন ওই কথা বলেছিলেন সুশান্তরঞ্জন। কিন্তু তার পরেও যদি রিটার্নিং অফিসারের রিপোর্টেই তাঁর হাত-পা বাঁধা থাকে, তা হলে নির্বাচন কমিশনারের পদ রেখে লাভ কী, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রেরই খবর, ভোটের দিন মৌখিক ভাবে গোলমাল এবং অনিয়মের কথা বললেও নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা লিখিত রিপোর্টে সে কথা বলেননি। এবং পর্যবেক্ষক ও রিটার্নিং অফিসারের (যাঁরা সকলেই রাজ্য সরকারি আধিকারিক) রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে স্বাধীন রিপোর্ট তৈরি করার এক্তিয়ারও নির্বাচন কমিশনারের নেই। সুশান্ত নিজে এ দিন বলেছেন, ‘‘যথাযথ নথি না থাকলে কমিশনের পক্ষে কিছু করার থাকে না। আইন তাই বলছে। তাই সব বুথে যথাযথ পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও কোনও বুথেই পুনরায় নির্বাচন হচ্ছে না।’’

রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের এই আইনি সীমাবদ্ধতার কথাই সোমবারেও বলেছিলেন সুশান্ত। নির্বাচনের দিন ঘোষণা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন— কোনও ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকার সুশান্তের কথা মানেনি। সুশান্ত মনে করেন, ভোটের দিন ঠিক করার ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া না হলে এবং নির্বাচনের কাজে যুক্ত সব সরকারি কর্মীকে কমিশনের নিয়ন্ত্রণে কাজ করানো না গেলে পরিস্থিতি বদলাবে না। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংস্থা হলেও তার ক্ষমতা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সমতুল নয়। রাজ্য সরকারের তৈরি নিয়মের আওতায় তাকে কাজ করতে হয়। তা হলে কমিশনারের নিজস্ব ভূমিকা যদি এতই সীমিত হয়, রাজ্য সরকারের আমলাই যদি শেষ কথা বলেন, তা হলে রাজ্য সরকারই তো নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে! যেমনটি হতো ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত!


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘কমিশন আর নবান্নের মধ্যে মিছিমিছি চোর-পুলিশ খেলা চলছে। এর চেয়ে নবান্ন ভোট পরিচালনা করলে লড়াইটা বরং সুবিধাজনক হতো।’’ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইঞা বলছেন, ‘‘সাংবিধানিক পদে বসে যে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা দরকার তা কমিশনার নিতে পারেননি। যা অবস্থা, তাতে কমিশন অফিসে তালা লাগিয়ে দেওয়া হলেই ভাল।’’

সংবিধান অনুযায়ী, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন পরিচালনা করে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এবং তাদের রাজ্য শাখা। আর পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভোট পরিচালনা করার জন্য প্রতিটি রাজ্যে পৃথক নির্বাচন কমিশন রয়েছে, যা রাজ্য নির্বাচন কমিশন হিসাবেই পরিচিত।

সাধারণ নিয়মে, ভোটের দিন ঘোষণা থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কাজ পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর এখানেই পঞ্চায়েত ও পুরভোটকে কেন্দ্র করে এ রাজ্যে সরকারের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরোধ একেবারে বেআব্রু হয়ে গিয়েছে।

কী রকম? ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন মীরা পাণ্ডে। সে সময় ভোটের দিন ঘোষণার এক্তিয়ার কার, তা নিয়েই সরকারের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব শুরু। অভিযোগ ছিল, সে বার পঞ্চায়েত আইন না মেনে, কমিশনের সঙ্গে সহমতের বদলে একতরফা ভোটের দিন ঘোষণা করে দিয়েছিলেন নবান্নের কর্তারা। প্রতিবাদে মীরা আদালতে যান। শেষে সুপ্রিম কোর্টের রায় কমিশনের পক্ষে যায়।

ওই ঘটনার পরে মীরা চেয়েছিলেন, সংবিধানের ‘২৪৩ কে’ ধারা অনুযায়ী, পঞ্চায়েত ও পুরভোটে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের ভার থাকুক রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপরেই। আদালত এই নিয়ে চূড়ান্ত কোনও রায় দেয়নি। সে বার আদালতের সাহায্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীও আনতে সক্ষম হন অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার মীরাদেবী। সেই ট্র্যাডিশন এই পুরভোটেও অব্যাহত।

সরকারি কর্তাদের মতে, এই যে পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভোট পরিচালনায় পদে পদে সরকারের সঙ্গে কমিশনের ঠোক্কর লাগছে, তার জন্য দায়ী রাজ্যের তৈরি আইন। কী রকম? সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সংবিধানে দেশের নির্বাচন কমিশনকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কী— তা-ও স্পষ্ট করে বলা রয়েছে ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে। এই আইনের ১৯ এবং ২০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ভোটের দিন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এই প্রেক্ষিতেই ১৯৯৪ সালে সংবিধানের ৭৩ এবং ৭৪তম সংশোধনীতে পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনায় রাজ্য ভিত্তিক পৃথক নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়। কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকেই। এর ফাঁক দিয়েই অনেক রাজ্য নিজেদের তৈরি আইনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে কার্যত কাগুজে বাঘ করে রেখেছে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গ। যেমন, সুশান্তরঞ্জন।

রাজ্য নির্বাচন কমিশনে সর্বোচ্চ পদে কাজ করা শীর্ষ আমলাদের একাংশ জানিয়েছেন, সংবিধানের ৩২৪(১) ধারায় নির্বাচন কমিশনকে রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা এবং লোকসভা ভোট পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংশোধন হওয়ার পর ২৪৩-কে ধারায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেও পঞ্চায়েত এবং পুরভোট পরিচালনার জন্য একই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব খাতায়-কলমেই। কারণ, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের বলে ভোটের সময় প্রশাসনের উপরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সেই ক্ষমতা নেই। রাজ্য তার আইনে সেই ক্ষমতা দেয়নি। রাজ্যের আইনে কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। বিশেষত, ভোটের দিন ঠিক করা এবং পঞ্চায়েত-পুর ভোটের সময় পুলিশ-প্রশাসনের উপর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে রাজ্যের আইনে কমিশনকে কোনও ক্ষমতা দেওয়া নেই। আর যার ফলে সরকারের সঙ্গে কমিশনের প্রতি পদে বিরোধ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন ওই অফিসারেরা।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার যে চেষ্টা, তা নির্ভর করে কমিশনের পদাধিকারীর উপরে। যেমন, মীরা পাণ্ডে। যিনি সরকারের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছিলেন। অন্য জন সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়, দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিনেই বলেছিলেন, সরকারের সঙ্গে সংঘাত নয়, সহযোগিতার ভিত্তিতেই তিনি কমিশনের কাজ চালাতে চান।

বাম সরকারের যে মন্ত্রীর হাত ধরে রাজ্যের এই আইন হয়েছিল, সেই প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘সংবিধানে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং রাজ্যের আইন যা আছে, তাতেও নিরপেক্ষ ভাবে ভোট করা যায়। কিন্তু সেটা নির্ভর করে কমিশনারের ব্যক্তিত্ব এবং যোগ্যতার উপর।’’ অশোকবাবুর মতে, ‘‘বর্তমান কমিশনারের সে যোগ্যতা নেই। ফলে রাজ্য সরকারেরই একটি অফিসে পরিণত হয়েছে কমিশন।’’ রাজ্যের বর্তমান পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পাল্টা, ‘‘কমিশনকে তো শিকল সিপিএম-ই পরিয়ে গিয়েছে। কমিশনকে সেই আইন মেনেই চলতে হচ্ছে।’’

অবাধ নির্বাচন পরিচালনা করার কোনও ক্ষমতা যে তাঁর নেই তা কলকাতার পুরভোটে প্রমাণ হয়ে যাওয়ার পরেও, ২৫ এপ্রিলের ভোট নিয়ে এ দিন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি, ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার, হুগলির পুলিশ সুপারের সঙ্গে বৈঠক করেন সুশান্তরঞ্জন। বাইক বাহিনী রোখা, ভোটের দিন বহিরাগতদের ঢুকতে না দেওয়ার মতো নির্দেশিকা ফের সেখানে জারি করেছে কমিশন। যদিও কলকাতার ভোটের সময়ে সেই নির্দেশ যে অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয়নি তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এবং কোনও ক্ষেত্রেই কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি কমিশন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE