বাবুল সুপ্রিয়ের জন্য ইচ্ছাপূরণে যে কাঁটা পড়েছিল, সৃঞ্জয় (টুম্পাই) বসুর সৌজন্যে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! দোলা সেনকে সংসদে পাঠাচ্ছেন তিনি! সৃঞ্জয়ের ছেড়ে-যাওয়া রাজ্যসভার শূন্য আসনে দলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলাকেই বেছে নিয়েছেন মমতা। যে হেতু ওই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই সাড়ে তিন বছরের জন্য (সৃঞ্জয়ের আসনের বাকি মেয়াদ) দোলার সাংসদ হওয়া প্রায় নিশ্চিত।
আসানসোল লোকসভা কেন্দ্র থেকে গত বছর দোলার পরাজয় ভাল ভাবে নেননি তৃণমূল নেত্রী। একে তো বিজেপির গায়ক-প্রার্থীর কাছে তাঁর পছন্দের নেত্রীর হার মমতার গায়ে জ্বালা ধরিয়েছিল। তার উপরে আসানসোলে দলেরই একাংশের ‘অন্তর্ঘাত’ তাঁকে আরও ক্ষিপ্ত করেছিল। তার জেরে তৃণমূলের অন্দরে জলও গড়িয়েছিল বহু দূর। কিছু দিন আগেও দলের সম্মেলন উপলক্ষে দুর্গাপুরে গিয়ে আসানসোলের এক দলীয় নেতাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন মমতা। বলেছিলেন, দোলাকে হারিয়ে দিয়ে আসলে তাঁকেই অসম্মান করা হয়েছে! শেষ পর্যন্ত সারদা-কাণ্ডে ধৃত সৃঞ্জয় জামিন পেয়ে রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ায় যে সুযোগ মমতা পেয়েছিলেন, তাকেই তিনি কাজে লাগালেন দোলার আসানসোল-ক্ষতে প্রলেপ লাগানোর জন্য। এ বার অন্তত দলের ‘অন্তর্ঘাতে’র কাঁটায় দোলার যাত্রাভঙ্গের আশঙ্কা নেই!
তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার ব্যাখ্যা, “রাজ্যসভার শূন্য আসনে কে যাবেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছিল। দোলাকে বেছে নিয়ে দলনেত্রী বুঝিয়ে দিলেন, শিল্পী, সাংবাদিক বা বিশিষ্ট মুখের চেয়ে আপাতত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, লোকসভায় আমাদের সাংসদদের ৩৫.২% মহিলা হলেও রাজ্যসভায় এই দিকটা একটু পিছিয়ে ছিল। এ বার রাজ্যসভাতেও মহিলা মুখ তুলে আনা গেল।” দলের অন্দরে তৃণমূল নেত্রী ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন, কলকাতা-সহ আসন্ন পুরভোটেও তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় রাজনৈতিক মুখেরই প্রাধান্য থাকবে।
দোলার প্রার্থী-পদের ঘোষণা অবশ্য বুধবার তৃণমূল ভবন থেকে হয়নি। দলের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা নবান্নে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছেন দুই বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। রাজ্যসভায় এ রাজ্য থেকে শূন্য একমাত্র আসনটির জন্য ১০ মার্চ মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। সুব্রতবাবু জানান, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নেতৃত্বে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, অমিত মিত্র, পূর্ণেন্দু বসু, ফিরহাদ হাকিম, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কমিটি করে রাজ্যসভার প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সুব্রতবাবু বলেন, “রাজ্যসভায় আমাদের মহিলা প্রতিনিধি কম ছিল। আমরা দোলা সেনের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী তা গ্রহণ করেছেন।”
কয়েক বছর আগে ফরওয়ার্ড ব্লক সাংসদ বরুণ মুখোপাধ্যায় পদ ছেড়ে দেওয়ায় তাঁর জায়গায় বাকি মেয়াদের জন্য সিপিআইয়ের রামচন্দ্র সিংহ রাজ্যসভায় গিয়েছিলেন কোনও নির্বাচন ছাড়াই। দোলার ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রায় নিশ্চিত।
রাজ্যসভার প্রার্থী করার পাশাপাশি দলের আইএনটিটিইউসি-র সর্বভারতীয় সভানেত্রী করা হয়েছে দোলাকে। আপাতত সুব্রতবাবুই সংগঠনের রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব সামলাবেন। আর কার্যকরী সভাপতি শোভনদেব ও প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের একাংশের মতে, শ্রমিক সংগঠনে এখন কার্যক্ষেত্রে দোলার বিশেষ ভূমিকা থাকবে না। দিল্লিতেই বরং তাঁকে মনোযোগ দিতে হবে।
দলের সিদ্ধান্ত জানার পরে দোলা এ দিন বলেছেন, “আমি চির কালই দলের অনুগত সৈনিক। দল যা দায়িত্ব দেবে, তা যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করব।” বস্তুত, আসানসোলে হারের জন্য দলেরই একাংশের অসহযোগিতার দিকে আঙুল উঠলেও দোলা কখনও তা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। ‘শৃঙ্খলাপরায়ন সৈনিক’ হিসাবে থেকে যাওয়ার পুরস্কার তাঁকে দিলেন মমতা। প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই, অসংগঠিত শ্রমিকদের সুরক্ষা প্রকল্পের মতো বহু বিষয় আছে যা সাধারণ দৃষ্টিতে অত্যন্ত নীরস কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে সে সব নিয়ে প্রতিনিয়ত বেশ গুরুত্বপূর্ণ লড়াই চলে। সিপিএমের হয়ে যে কাজ করার জন্য সিটুর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন রাজ্যসভায় আছেন, অতীতে শ্যামল চক্রবর্তী ছিলেন। দোলা এ বার তৃণমূলের হয়ে সেই কাজেই মন দিতে পারবেন।
দোলাকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের কিছু নেতা-নেত্রীকে মমতা আরও একটি বার্তা দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রের মত। অধুনা মমতা-ঘনিষ্ঠ এক গায়ক প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন, রাজ্যসভায় তাঁর টিকিট বাঁধা! ইংরেজি বলিয়ে-কইয়ে এক নেত্রীও মহিলা মুখ হিসাবে রাজ্যসভায় যেতে উৎসুক ছিলেন। দলের এক নেতার কথায়, “দোলাকে প্রার্থী করে মমতা বুঝিয়ে দিলেন, কারও নিজেকে তুলে ধরার বেশি চেষ্টা তিনি প্রশ্রয় দেন না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy