সিঙ্গুরের সভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং নিরুপম সেন। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
পদযাত্রীদের পায়ে পায়ে ধুলোর মেঘ তখন। ধোঁয়াটে আস্তরণ ভেদ করেই মঞ্চের স্লোপ (সিঁড়ি নেই) ধরে নামছেন তিনি। আশপাশ থেকে উড়ে আসছে অজস্র সেলাম, একের পর এক হাতও। চেনা মুখ দেখে তিনি জানতে চাইলেন, কেমন হল? উত্তরও নিজেই দিলেন— ‘‘বেশ ভাল না?’’
রাস্তার উল্টো দিকেই ঝোপঝাড় গায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক খণ্ডহর! সব কিছু ঠিকঠাক চললে রতন টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা হয়ে ওঠার কথা ছিল যার! সব ঠিকমতো চললে তাঁকেই বা কি ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র নিয়ে এত ঘাম ঝরাতে হতো? ইতিহাসের গতি তাঁকে ‘ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী’র তকমা দিয়ে রাস্তার ধারে ফেলে গিয়েছে! এই সিঙ্গুরেই! দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধার থেকেই সেই তিনি ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের আগে ফের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। ভোটের মার হজম করেছেন। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে হাতের যষ্টিটা একই আছে— শিল্প!
বলে রাখা যাক, নিজেরই ব্যর্থভূমে ফের এসে দাঁড়াতে প্রবল সঙ্কোচ ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। ব্যর্থতার চেয়েও তাঁর কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক অবশ্য স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। শেষমেশ ঠিক করেন, এসে না হয় বাস্তবের মুখোমুখিই দাঁড়াবেন। দলা-পাকানো ভিড় সরাতে সরাতে গোপালনগর-সাহানাপাড়ার মোড়ে এক বার এসে পড়ার পরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বেশ আশ্বস্ত! এখনও তা হলে কথা শুনতে লোক আসে! সেই সিঙ্গুরে!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ট্রিগার টিপে দেওয়া’কে দায়ী করে রতন টাটা সিঙ্গুর ছেড়েছিলেন ২০০৮ সালের অক্টোবরে। তার পরে আর সিঙ্গুরে তেমন একটা আসেননি বুদ্ধবাবু। এই রাস্তার উপর দিয়ে গিয়েছেন অনেক বার। কারখানার কঙ্কালটা দেখেছেন। কিন্তু এ বার এত দিন পরে এক্কেবারে খাস সিঙ্গুরেই কর্মসূচি। বুদ্ধবাবুর কথায়, ‘‘অনেক বার ভেবেছি, আসব কি আসব না। কিন্তু এসে বেশ ভাল লাগল। এত মানুষ। এত ভাল মেজাজ জমায়েতটার। কত তরুণ ছেলে-মেয়েরা এসেছে। এটা তো আরও ভাল!’’ এই মেজাজ ধরে রাখাই তাঁদের কাছে চ্যালেঞ্জ, খোলাখুলি মানছেন।
মঞ্চে বসেই তখন হাসছেন আর এক প্রাক্তন। এবং বুদ্ধবাবুর সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘ব্যর্থ’ তকমা তাঁর গায়েও! মাঝে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের গুরুতর ধাক্কা সামলে উঠে নিরুপম সেন এখন হুইল চেয়ারে। সিঙ্গুরের শনিবারের জমায়েত এবং মিছিল তাঁর চোখেও হাল্কা রুপোলি রেখা এনে দিয়েছে। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী বলছেন, ‘‘এখনও এত মানুষ এসেছেন। শিল্পের কথা শুনছেন। ভাল লাগছে! শিল্পই তো চেয়েছিলাম। আর কিছু তো না!’’
বামপন্থীদের মধ্যেই এক অংশের মানুষ এখনও মনে করেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জন্য আরও খোলাখুলি ভুল স্বীকার করে তবেই এগোনো উচিত সিপিএমের। সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’দের অনেকের মত, সেই সময় আরও আলোচনা করে জমি নিলে তাঁরা রাজিই হয়ে যেতেন! কিন্তু এ দিনের সিঙ্গুর থেকে তেমন কিছু ইঙ্গিত তো মিলল না? এই তত্ত্বে সায় দিচ্ছেন না নিরুপমবাবু। তাঁর যুক্তি, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম এক নয়। আর দুই পর্বকে ঘিরে দলের আলোচনায়, দলিলে পর্যালোচনা করে ত্রুটি স্বীকার করাও হয়েছে। নিরুপমবাবুর কথায়, ‘‘সিঙ্গুরে অধিকাংশই জমি দিয়েছিলেন। কিন্তু জোর করে কারখানাটা করতে দেওয়া হয়নি। বাধা দিয়ে একটা জিনিস করতে দেওয়া হল না! তার জন্য আর কী ভুল স্বীকার করব?’’
সিঙ্গুরের জমি ফেরত যেমন তৃণমূল নেত্রীর মাথাব্যথা, তেমনই ভুলের ভুল-ভুলাইয়া অবশ্য বামফ্রন্টেরও পিছু ছাড়ার নয়! আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য যেমন এ দিনের মঞ্চেই বলেছেন, ন্যানো-পর্বে পদ্ধতিগত ত্রুটি তাঁদের ছিলই। সেই সঙ্গেই তাঁর আরও প্রশ্ন, এক্সপ্রেসওয়ের উপরে তৃণমূল নেত্রীর টানা ২৪ দিনের অবস্থান পুলিশ দিয়ে তুলে দিলেই কি ভাল হতো না? বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু অবশ্য জবাবও দিয়ে দিয়েছেন, গণতান্ত্রিক রীতির উপরে বামফ্রন্ট ভরসা রাখে বলেই সে পথে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর বুদ্ধবাবু ফের জোর গলায় বলছেন, কৃষিকে বাঁচিয়ে শিল্পের পথে এগোনোই পথ! সে পথে ভুল ছিল না!
খণ্ডহরের উল্টো দিকে দাঁড়িয়েই বুদ্ধবাবু আরও দেখে গেলেন, কারখানা হবে না বলে সিঙ্গুরে একক সভা করে হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছিল যে ফরওয়ার্ড ব্লক, তারাও আজ ভাল সংখ্যায় লোক এনেছে শিল্পের দাবিতে মিছিলের জন্য! স্বস্তির হাসির মাঝে এক বারই শক্ত হয়েছিল তাঁর চোয়াল। পদযাত্রার উদ্বোধনের জন্য বিপিএমও-র বাড়িয়ে দেওয়া সাদা পতাকা সরিয়ে ভিড়ের কাছ থেকে একটা লাল ঝান্ডা চেয়ে নিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
ইতিহাসের যাত্রাপথেই তিনি তো এখন লড়াইয়ের সৈনিক। সাদার চেয়ে সে লড়াইয়ে লালই মানায় ভাল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy