Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

শাসনে সন্ত্রাসের অভিযোগ এখন মজিদের মুখেই

নিরাপদে নিজের এলাকায় ফিরতে এখন তৃণমূল নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী তিনি। শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তাঁর মুখে। কথা হচ্ছিল শাসনের এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা মজিদ আলি ওরফে মজিদ মাস্টারের সঙ্গে। দাঁড়িয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে, জেলাশাসকের অফিসের দোতলার এককোণে। জেলার পাঁচ জন বাম প্রার্থী সোমবার মনোনয়মন জমা দিতে এসেছিলেন বারাসতে।

সীমান্ত মৈত্র
শাসন শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

নিরাপদে নিজের এলাকায় ফিরতে এখন তৃণমূল নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী তিনি। শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তাঁর মুখে।

কথা হচ্ছিল শাসনের এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা মজিদ আলি ওরফে মজিদ মাস্টারের সঙ্গে। দাঁড়িয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে, জেলাশাসকের অফিসের দোতলার এককোণে। জেলার পাঁচ জন বাম প্রার্থী সোমবার মনোনয়মন জমা দিতে এসেছিলেন বারাসতে। তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন জেলা কমিটির সদস্য মজিদ।

ভোটের হাওয়া কেমন বুঝছেন? প্রশ্ন শুনে শুরুতেই একরাশ বিষণ্ণতা ঝরে পড়ল গলায়। বললেন, “আমি তো প্রার্থী নই। রাস্তার মানুষ। আমি আর কী বলব।”

একটা সময় অবশ্য ছিল, যখন শুধু তিনিই বলতেন। বাকিরা শুনত। অন্তত বারাসত ২ ব্লকের শাসন এলাকায় মজিদ মাস্টারের কথাই ছিল ‘শেষ কথা’। কিন্তু সে দিন গিয়েছে। সেই শাসনে সিপিএমের মুঠো আলগা হয়েছে। জেলার অন্য প্রান্তের মতোই তৃণমূলের হাওয়ায় গা ভাসিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার কুখ্যাত এই ভেড়ি এলাকা।

কুখ্যাত কেন? তার উত্তর শাসনের হাওয়ায় কান পাতলেই শোনা যায় এখনও। ভেড়ি এলাকায় কাঁচা টাকা বাতাসে ওড়ে। আর অপরিমিত টাকার লেনদেন ছোট-বড়-মেজো নানা মাপের, নানা রঙের বাহুবলীদের তৈরি করেছে এখানে। কিন্তু নিন্দুকেরা বলে, সেরার সেরা ছিলেন মজিদই। যার স্বাভাবিক পরিণতিতে শাসনে একের পর এক খুন-জখম সন্ত্রাসের অভিযোগে তাঁর নাম জড়িয়েছে। এক সময়ে সিপিএমের রাজ্যস্তরের নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে দহরম মহরম ভালই ছিল মজিদ মাস্টারের। কিন্তু গত বিধানসভা ভোটের আগে তাঁর আলিমুদ্দিনে যাওয়াটা ভাল ভাবে নেননি নেতৃত্বের অন্য একটি অংশ। ওই ঘটনার দিন কয়েকের মধ্যেই গ্রেফতার হয়ে যান মাস্টার।

খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পরে মজিদ জামিনে ছাড়া পান। তত দিনে এলাকায় তৃণমূল রাজনৈতিক জমি পেতে শুরু করেছে। একবার এলাকায় ঢোকার মুখে মজিদের গাড়ি ঘিরে ধরে তাঁকে মারধর করা হয়। তারপর থেকেই পাকাপাকি এলাকা ছাড়া মজিদ। নিজেই জানালেন, এ বার ভোটের প্রচারে বেরোচ্ছেন। জেলার নানা প্রান্তে ঘুরছেন। কিন্তু নিজের একদা খাসতালুকেই পা রাখতে পারেননি এখনও। ইতিমধ্যে গত পঞ্চায়েত ভোটে মজিদের স্ত্রী জেলা পরিষদ আসনে দাঁড়িয়েছেন এবং হেরেওছেন। মজিদ বুঝে নিয়েছেন, এলাকায় তাঁর সেই নামডাক এখন অস্তমিত। জানালেন, ইদানীং কাজিপাড়ায় বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। স্ত্রী-পুত্র অবশ্য শাসনের বাড়িতেই আছেন।

কাদের ভয়ে ফেরেন না নিজের বাড়িতে?

মজিদ বলেন, “রাজ্যের এক মন্ত্রী তো বলেছেন, আমি এলাকায় গেলে নাকি মেয়ে-বউরা বঁটি নিয়ে আমাকে কাটতে আসবেন। কিন্তু সেই মন্ত্রীকে বলি, আপনি তো আমারও মন্ত্রী। রাজ্যের অন্য নাগরিকদের মতো আমাকে নিরাপত্তা দেওয়াও তো আপনারই দায়িত্ব।”

মজিদ নাম বলেননি ঠিকই। কিন্তু জেলা রাজনীতিতে সকলেই জানেন, কাকে ইঙ্গিত করে এ কথা শোনালেন মাস্টার। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকই এক সময়ে জনসভায় বলেছিলেন, মজিদ এলাকায় ঢুকলে মহিলারাই লাঠিসোঁটা-বঁটি নিয়ে নাকি মাস্টারকে প্রতিরোধ করবেন। জ্যোতিপ্রিয়র সেই বক্তব্য নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। কী বলছেন মন্ত্রী এখন?

জ্যোতিপ্রিয়র কথায়, “গ্রামের মানুষের আবেগ অন্য রকম। সেটা বুঝতে হবে। তাঁরা চান খুন, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, ভেড়ি লুঠের অভিযোগ আছে যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁরা আগে আদালতে সমস্ত মামলা থেকে বেকসুর খালাস হয়ে আসুন। তারপরে তাঁরা গ্রামে যান। তা হলেই মানুষ মেনে নেবেন, তিনিই সঠিক ছিলেন।’’ মজিদ অবশ্য জানাচ্ছেন, তাঁর বিরুদ্ধে চলা সমস্ত মামলায় তিনি ইতিমধ্যেই জামিন পেয়েছেন। কিন্তু জামিন নয়, বেকসুর খালাস পেলেই তবে তাঁর সম্পর্কে মানুষের মন বদলাবে, মনে করেন জ্যোতিপ্রিয়। আর তাই মজিদ যে আপাতত গ্রামে ফিরছেন না, তা এক রকম নিশ্চিত।

নিরাপত্তা নিয়ে কি আতঙ্কে আছেন? প্রশ্ন শুনে এত ক্ষণে ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি ছুঁয়ে গেল প্রবীন সিপিএম নেতার। বললেন, “সৎ মানুষ আতঙ্ক বোধ করতে পারেন না। কিন্তু তৃণমূল শাসনে সন্ত্রাস করছে।” কেমন সেই সন্ত্রাসের নমুনা? মজিদ জানান, বেলিয়াঘাটায় তাঁদের কার্যালয় বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। কোথাও বামেদের কর্মিসভা হলে নজর রাখছে তৃণমূলের লোকজন। সভায় কে আসছে যাচ্ছে সব দিকে কড়া নজর তাদের। দেওয়াল লিখতে দিচ্ছে না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসাচ্ছে। এ সব অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ শাসক দল।

কিন্তু এত সবের পরেও শাসনে ভোট কেমন হবে? মজিদ বলেন, “ওরা যতই সন্ত্রাস করুক, মানুষ এ বার যে কোনও পরিস্থিতিতে ভোট দেবেনই। আর সেই ভোটটা আসবে আমাদের পক্ষেই। সন্ত্রাস, হুমকি দেখে দেখে মানুষ ক্লান্ত।”

কিন্তু আপনার বিরুদ্ধেও তো সন্ত্রাসের অভিযোগ ভুরি ভুরি। প্রশ্ন শুনে মুখের পেশি টান টান হয়ে ওঠে মজিদের। বলেন, “সব মিথ্যা অভিযোগ। ১৯৯৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের হিসেব দিলেই বুঝতে পারবেন ব্যাপারটা।” কী সেই হিসেব? মাস্টার জানালেন, সে বার বারাসত ২ ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬টিই পেয়েছিল বাম বিরোধীরা। জেলা পরিষদের দু’টি আসনের একটি সিপিএম জিতলেও অন্য আসনটিতে মজিদ নিজে ভোটে দাঁড়িয়ে হারেন। “আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ সত্যি হলে কি আমাদের এই ফল হত?” পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন মজিদ।

উল্টো ব্যাখ্যা অবশ্য দিলেন শাসনের তৃণমূল নেতা সাহিদুল আলি। জানালেন, মজিদের দেওয়া পরিসংখ্যান ভুল নয়। কিন্তু শাসন পঞ্চায়েতের ফল অন্য কথা বলে। মজিদের খাসতালুক ওই পঞ্চায়েতের ১৪টি আসনের মধ্যে সে বার মাত্র ২টি আসন পেয়েছিল তৃণমূল।

তথ্য ও পরিসংখ্যানে চাপান-উতোর চলতেই থাকবে। কিন্তু বাস্তব হল, জমি-জিরেত ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন মজিদ। বাস্তব হল, যে গ্রামে এক সময়ে বিরোধীদের একটা পতাকাও দেখতে পাওয়া যেত না, সেখানে এখন দূরবীন দিয়ে খুুঁজতে হবে লাল পতাকা।

দিন কারও সমান যায় না মজিদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে উড়ো মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন এক তৃণমূল নেতা।

অন্য বিষয়গুলি:

majid master simanta moitro sashan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE