আরাবুলের আহার। ভাঙড়ের হাতিশালায়। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
কখনও বোরখার আড়ালে পুরুষকণ্ঠে শাসানি। কখনও রাতবিরেতে পাড়ায় পাড়ায় মোটরবাইক বাহিনীর হুমকি। কয়েক দিন ধরে লাগাতার এই চিত্রই দেখে এসেছেন ভাঙড়ের বিভিন্ন গ্রামের ভোটাররা। এ দিন তাই ভোট দিতে এলেনই না এলাকার বহু মানুষ।
ভাঙড় বিধানসভা এলাকায় এ বার মোট বুথের সংখ্যা ছিল ২৬৫টি। তার মধ্যে ২০০টিকে ‘অতি স্পর্শকাতর’ এবং ৬৫টিকে ‘স্পর্শকাতর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল প্রশাসন। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত গ্রাম্য পথের কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মেলেনি। মাঝেমধ্যে অবশ্য বড় রাস্তায় দেখা গিয়েছে কয়েকটি গাড়ি। সিটে বসে জলপাই রঙা পোশাক পরা জওয়ানরা। তবে তাঁরা কেউই গ্রামের ভিতরে ঢোকেননি। বুথের মধ্যে ও আশপাশেই ঘোরাফেরা করেছেন জওয়ানরা। আর তাঁদের সামনেই দিব্যি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বাইক বাহিনী। জওয়ানরা নির্বিকার, নিশ্চিন্ত। এতটাই যে, দুপুর ১টা নাগাদ পোলেরহাট হাইস্কুলে কয়েক জন জওয়ান রীতিমতো দিবানিদ্রাও দিয়েছেন।
আর সেই কারণেই ভাঙড়ের কুলদাড়ি, বামুনঘাটা, বোদরা, বানেরআইট ইত্যাদি এলাকার বিভিন্ন বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও ভিতরে বিরোধী এজেন্টদের দেখা মেলেনি। বেঞ্চে বসে ছিলেন শাসক দলের এজেন্টরাই। ভোটারের হাতে কালি লাগানোর পরে অনেক জায়গাতেই শাসক দলের এজেন্ট নিজেই উঠে গিয়ে ভোটযন্ত্রের বোতাম টিপে দিয়েছেন বলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন ভোটাররা। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। অভিযোগ, জওয়ানরা তাঁদের বলেছেন, তাঁরা বুথের বাইরের নিরাপত্তা দেখছেন। কুলদাড়ি এলাকার এক ভোটার বললেন, “বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গেই এজেন্টরা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমি ‘নোটা’ দিয়েছি। তা-ও শাসানি দিয়েছে।”
বোদরা এলাকার এক তৃণমূল নেতার কথায়, “কোথায় ভোট পড়ল, তা দেখে নিতে বলেছি আমরা। এ সব নিয়ে আপনারা (সংবাদমাধ্যম) মাথা ঘামাবেন না। এখানে সবই তো নিজেদের লোক। তাই এক বার দেখে নেওয়া আর কি!” এই বিষয়ে বুথে কতর্ব্যরত প্রিসাইডিং অফিসার কোনও মন্তব্য করেনি। যে সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই, সেখানে ভিডিও বা ওয়েবক্যাম রাখার কথা বলেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু অধিকাংশ বুথেই ওই ক্যামেরা চালু ছিল না বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা।
দলীয় কর্মীদের এই কাজে যারপরনাই খুশি ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম। সকাল ৮টা থেকে ভাঙড়-২ এলাকায় একের পর এক বুথে গিয়ে ভোটকর্মীদের ‘উৎসাহ জোগাতে’ শুরু করেছিলেন তিনি। ঘণ্টা দুয়েক ঘোরার পর সকাল ১০টা নাগাদ হাতিশালায় দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে বসলেন। দু’হাতে মোট চারটি মোবাইল ফোন। একের পর এক ফোন আসছে। হাসিমুখে সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছেন আরাবুল। এর মধ্যেই একটি মোবাইল হাত থেকে নামিয়ে বললেন, “দিদি, মুকুলদা, পার্থদা সকলেই জানতে চাইছেন, এখানে কী হচ্ছে? জানালাম, সব ঠিক হ্যায়। ওঁরা যেমন চাইছেন, তেমন করছি।”
নিশ্চিন্ত আরাবুল খেতে বসলেন। গোটা ছয়েক লুচি ও ছোলার ডাল। খেয়ে ফের আসনে বসতে না বসতেই আবার মোবাইল বাজল। এ বার কিছুটা উত্তেজিত শোনাল তাঁর গলা। চেঁচিয়ে বললেন, “ঘিরে ধরো। কাগজপত্র দেখতে চাও। না হলে বুথ ঘিরে ফেলো।” পাশের এক সঙ্গীকে বললেন, “বিকাশ ভট্টাচার্য এসেছেন বামুনঘাটার বুথে।” সঙ্গীটি বললেন, “উনি সুজনবাবুর নির্বাচনী এজেন্ট।” এ বার আরাবুল অপ্রস্তুত। বললেন, “জানতাম না।” ফোনে নির্দেশ, “ওঁকে ছেড়ে দাও। ঝামেলা বাড়বে।” তবে এ বার গাড়িতে বসে বুথ প্রদক্ষিণ শুরু করলেন তৃণমূল নেতা।
বেলা সওয়া ১২টা। কুলদাড়ি প্রাথমিক স্কুলের কাছে পৌঁছে আরাবুল দেখলেন, কয়েক জন তৃণমূল কর্মীর জটলা। এক জন এসে বললেন, “সিপিএমের কয়েক জন বসে। ওদের ভোট দিতে নিষেধ করেছি। কিন্তু তা-ও নড়ছে না।” সকাল থেকে মুখে ঝুলিয়ে রাখা হাসিটা পুরোপুরি উধাও হল এতক্ষণে। আচমকা গাড়ি থেকে নেমে বুথের কাছে বসে থাকা সিপিএমের ভোটারদের তাড়া করলেন আরাবুল। তাঁর সঙ্গী শাসালেন, বুথের পাশ থেকে না গেলে সন্ধের পরে ঘরবাড়ি আর আস্ত থাকবে না। আরাবুলের ওই মূর্তি দেখে আর এলাকায় থাকতে সাহস পাননি ওই ভোটারেরা।
বিকেলে কুলদাড়ি থেকে বামুনঘাটায় কার্যালয়ে ফিরলেন আরাবুল। ততক্ষণে তিনি ‘রিল্যাক্সড’। চেয়ারে গা এলিয়ে বললেন,“ভাঙড়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে। সিপিএম শুধুই মিথ্যা অভিযোগ করে চলেছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy