কঙ্কণদিঘিতে উদ্ধার হওয়া জম্ভল মূর্তি। —নিজস্ব চিত্র।
বাঁ হাতে ধরা একটি বেজি। বৌদ্ধ দেবতা জম্ভল সন্তুষ্ট হলে সেই বেজিতে চাপ দেন। বেজি উগরে দেয় রত্নরাজি। হিন্দু কুবেরের সঙ্গে তুলনীয় সেই জম্ভলের একটি পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কঙ্কণদিঘি থেকে। জম্ভলের পোড়ামাটির মূর্তি দক্ষিণবঙ্গে বিরল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই এলাকায় খননকার্য করেছে বিভাগীয় প্রধান দুর্গা বসুর নেতৃত্বে।
কঙ্কণদিঘির জম্ভল বসে রয়েছেন ললিতাসনে। অর্থাৎ পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের উপরে বাঁ পা ভাঁজ করে রাখা। ডান পা আসন থেকে নেমে ঠেকেছে ঘট বা রত্নকলসের উপরে। এমন ভাবেই পা ও ঘটটি রয়েছে, যেন দেবতা পা দিয়ে ঘটটি হেলিয়ে দিয়েছেন তাই সেই ঘট থেকেও উপছে পড়ছে রত্নসম্ভার। দুর্গাদেবী বলেন, “মূর্তিটির পায়ের অবস্থান থেকেই তাকে বৌদ্ধ দেবতা জম্ভল বলে চেনা যাচ্ছে। বাঁ হাতটি ভেঙে গিয়েছে। তবে বেজির অস্পষ্ট অবয়ব রয়েছে।”
কুবেরের মূর্তিও অনেকটা কাছাকাছি দেখতে। কুবের সম্পদের দেবতা এবং উত্তর দিকপাল। বৌদ্ধ জম্ভলও তাই। দু’জনেই স্থূলোদর, খর্বকায় এবং অলঙ্কারে ভূষিত। পুরাণ মতে কুবের নরবাহন। রামায়ণ ও পুরাণ মতে রাক্ষস রাবণের বৈমাত্রেয় দাদা কুবের যক্ষদের রাজা ছিলেন। যক্ষদের রূপই তাই তাঁর উপরে আরোপিত হয়েছে বলে পণ্ডিতদের মত। জম্ভলের রূপও যক্ষ থেকেই গৃহীত বলে অনুমান।
কঙ্কণদিঘিতে সন্ধান মিলেছে বৌদ্ধ উপাসকদের থাকার এই ছোট ছোট ঘর।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে সুঙ্গ যুগে ভারহুত শিলালিপিতেও উত্তর দিকপাল জম্ভলকে যক্ষই বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য মতেও খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে সাতবাহন রাজাদের আমলে নানাঘাট শিলালিপিতে উত্তর দিকপাল কুবের। তবে কুবেরকে প্রথমে দেবতা বলে তেমন ভাবে স্বীকারই করা হত না। তার জায়গায় দিকপাল ছিল সোম। দু’জনে একই রকম দেখতে হলেও জম্ভল মূর্তির পায়ের তলায় কয়েকটি ঘট থাকে। কঙ্কণদিঘি থেকে পাওয়া মূর্তিটিতে ৬টি ঘট পাওয়া গিয়েছে।
জম্ভলের মূর্তি বাংলা তথা পূর্ব ভারতের বিভিন্ন বৌদ্ধ প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গিয়েছে। আর তাই কঙ্কণদিঘির প্রত্নস্থলটিও বৌদ্ধ উপাসনাস্থল বলে অনুমান করা হচ্ছে। এখানে পাওয়া গিয়েছে বৌদ্ধ উপাসকদের থাকার ছোট ছোট ঘরও। ইটের নমুনা থেকে পুরাতত্ত্ববিদদের ধারণা, উপাসনাস্থলটি অন্তত এক হাজার বছরের পুরনো। দুর্গাদেবী বলেন, “নবম ও দশম শতক থেকে একাদশ-দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এই বৌদ্ধ উপাসনাস্থলটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল বলে অনুমান করা যায়।” যে জমিতে উৎখনন করা হয়েছে তার মালিক উমাশঙ্কর খান ও শিবশঙ্কর খান। তাঁরাও এই প্রত্ন নিদর্শনগুলির সন্ধান মেলায় খুশি। এখান থেকে পাওয়া গিয়েছে প্রদীপ, ছোট মাটির পাত্র, ছোট ও বড় কলস ও ভাণ্ড। যা থেকে অনুমান করা যায়, এখানে আবাসিকরা থাকতেন। পাওয়া গিয়েছে একটি পাথরের গণমূর্তিও। সম্ভবত উপাসনাস্থলের অলঙ্করণের জন্যই ওই মূর্তিটি তৈরি হয়।
কিন্তু মোক্ষকামী বৌদ্ধরা কেন ধনরত্নের দেবতা জম্ভলের পুজো করতেন? সেক্ষেত্রে বৌদ্ধদের একটি প্রচলিত কাহিনি রয়েছে লামা অতীশ বা অতীশ দীপঙ্করকে নিয়ে। কোনও একদিন তিনি একা ঘুরতে গিয়ে রাস্তায় হঠাৎ দেখতে পান অনাহারে কষ্ট পাচ্ছেন এক ব্যক্তি। আশেপাশে আর কাউকে দেখতে পেলেন না অতীশ। কোনও খাবারও সংগ্রহ করতে পারলেন না। তখন নিজের গা থেকে কেটে মাংস নিয়ে তিনি খেতে দিলেন সেই ব্যক্তিকে। তিনি অবশ্য তা খেতে অস্বীকার করেন। এই সময়ে অসহায় অতীশের সামনে আবির্ভূত হয় জম্ভলের এক রূপ। পৃথিবী থেকে অনাহার দূর করার জন্যই তাকে পুজো করা হয় বৌদ্ধধর্মে।
ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন, বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অনেক শ্রমণ ও ভিক্ষু থাকতেন। প্রতি দিন যে বিরাট কর্মযজ্ঞ চলত, তার জন্য দরকার ছিল অর্থবল। রাজা ও বণিকদের কাছ থেকে সেই অর্থ দান হিসেবে আসত। কিন্তু তাতেও উদ্বেগ কাটত না। তাই পুজো করা হত জম্ভলের। তা ছাড়া, জম্ভল রক্ষাকর্তাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy