অবরুদ্ধ রেললাইন, যশোহর রোড। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
দিনের ব্যস্ত মুহূর্তে হঠাৎই ডঙ্কা, কাঁসি বাজিয়ে নাচতে নাচতে এক দল লোক ভিড় জমালো রাস্তায়। নিমেষে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল যশোহর রোড। বন্ধ হয়ে গেল বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখার আপ ও ডাউন লাইনে ট্রেন চলাচল। আটকে পড়ে কয়েকটি অ্যাম্বুল্যান্সও।
অশোকনগর ব্লক মতুয়া মহাসঙ্ঘের তরফে দাবি, অবরোধকারীরা তাদের সংগঠনের সদস্য। তাদের সঙ্গে মতুয়াদের লাল-সাদা নিশানও ছিল। জমি জবরদখলের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই সোমবার সপ্তাহের শুরুর দিন সকাল ৯টা থেকে তারা অবরোধ করে অশোকনগরের ৩ নম্বর রেলগেটে। প্রবল গরমে গলদঘর্ম বেশ কিছু নিত্যযাত্রী বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ নেমে আসেন আপ বনগাঁ লোকাল থেকে। অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান তাঁরা। তাতে কাজ না হওয়ায় শুরু হয় ঝগড়াঝাটি। নিত্যযাত্রীদের পক্ষ নিয়ে বেশ কিছু গাড়ি চালক এবং যশোহর রোডের যাত্রীরাও চিৎকার-চেঁচামিচি শুরু করেন। তাঁদের বক্তব্য, স্থানীয় সমস্যা মেটাতে এ ভাবে অসংখ্য মানুষকে হয়রান করা অর্থহীন। যেখানে দাবি জানালে কাজ হবে, সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর পরামর্শ দেন তাঁরা। এক সময়ে কয়েকশো মতুয়া অবরোধকারীর সঙ্গে সামান্য ধস্তাধস্তিও বাধে নিত্যযাত্রীদের একাংশের।
ইতিমধ্যে খবর পেয়ে চলে আসে বিশাল পুলিশ বাহিনী, আরপিএফ, জিআরপি। তাদের হস্তক্ষেপে অবরোধ ওঠে বেলা ১১টা নাগাদ। অশোকনগর থানা সূত্রের খবর, জমি নিয়ে সমস্যা মেটাতে আগামী শনিবার সব পক্ষকে আলোচনায় ডাকা হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ও জানান, বিষয়টি এর আগে জানতেন না। এ বার আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।
নিত্যযাত্রীদের কেউ কেউ বলেন, এ ভাবে সপ্তাহের শুরুর দিন কোনও আগাম খবর না দিয়েই অবরোধ অত্যন্ত অন্যায়। বহু মানুষ নানা কাজ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন। অফিস-কাছারি তো বটেই, অনেক ছাত্রছাত্রীও থাকেন বাসে-ট্রেনে। অবরোধে কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকা মানে তাঁদের কাছে পুরো দিনটাই বরবাদ হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া এত গরম। বাসে-ট্রেনে কত বৃদ্ধ, শিশু, মহিলা যাতায়াত করেন। তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।
স্থানীয় সামান্য কারণে এ ভাবে অবরোধ করার আগে সকলের এক বার ভেবে দেখা উচিত। যে দফতরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, সেখানে গিয়ে প্রতিবাদ জানালেই হয়। তা ছাড়া, প্রয়োজনে সরকারের কানে কথা তোলার জন্য নবান্নে গেলেও পারেন বিক্ষোভকারীরা।
কয়েক বছর আগে বামনগাছিতে অসুস্থ ছেলে কোলে এক বাবার প্রতিবাদের সামনে পড়ে ট্রেন অবরোধ তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। বসিরহাট-বারাসত লাইনেও গত কয়েক বছরে বার কয়েক ট্রেন অবরোধ উঠে গিয়েছে নিত্যযাত্রীদের সম্মিলিত প্রতিবাদের সামনে। এ দিনও নিত্যযাত্রীরা প্রতিবাদ করার অবরোধ তোলার কাজ আরও সহজ হয়েছে পুলিশের পক্ষে। অবরোধকারীরাও জানিয়েছেন, পুলিশের সাহায্য পেয়েছেন তাঁরা।
কিন্তু কেন অবরোধ হল?
অবরোধকারীদের বক্তব্য, হাবরা ২ ব্লকের ভুরকুণ্ডায় তাঁদের কয়েকটি পরিবার বসবাস করে। সেই জমি দখলের চেষ্টা করছে স্থানীয় কিছু মানুষ। বিষয়টি পুলিশ-প্রশাসনকে জানানো সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অশোকনগর ব্লক মতুয়া মহাসঙ্ঘের গোঁসাই বিষ্ণুপদ রায় বলেন, “২২ বিঘা জমি জোর করে দখল করার চেষ্টা হচ্ছে। মাটি কেটে পুকুর বানানোরও চেষ্টা চলছে। আমরা অশোকনগরের বিধায়ক ধীমান রায়ের কাছে গিয়েছিলাম। উনি আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন।” বিষ্ণুপদবাবু জানান, মতুয়াদের সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের (নব নির্বাচিত বনগাঁর সাংসদ) সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি দিল্লি থাকায় সমস্যা হয়। কপিলবাবু বা তাঁর ভাই, রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ অবশ্য বিষয়টি জানেন না বলেই মন্তব্য করেছেন। ঘটনাস্থলে এসে অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার চেয়ারম্যান তৃণমূলের সমীর দত্ত জানান, যদি কেউ মতুয়াদের অভাব-অভিযোগে গুরুত্ব না দিয়ে থাকে, সে জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। বিষয়টি তিনি অবশ্যই দেখবেন।
এ রাজ্যে মতুয়ারা নানা দাবি-দাওয়া জানিয়ে বহু আন্দোলন করলেও এর আগে এ ভাবে তাদের অবরোধে নামতে দেখা যায়নি। কী তার কারণ, তা ভাবিয়ে তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলিকেও। স্থানীয় নেতৃত্বের কারও কারও মতে, মতুয়া বাড়ির বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর সম্প্রতি সাংসদ হয়েছেন। তাঁর ছোট ভাই এ রাজ্যের মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু দিন ধরেই মতুয়াদের গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ সব কারণেই মতুয়ারাও অনেকেই নিজেদের প্রভাবশালী ভাবতে শুরু করেছেন। সামান্য দাবি-দাওয়াও রাস্তায় টেনে এনে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তাঁরা।
ধীমানবাবুর বক্তব্য, “শনিবার ওঁরা এসেছিলেন আমার কাছে। আমি বলেছিলাম, বিধানসভার অধিবেশন সবে শুরু হয়েছে। আগামী শনি-রবিবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে মিটিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ওঁরা এটুকু সময় অপেক্ষা করলেন না।” বিধায়কের দাবি, বিজেপি ও সিপিএম পিছন থেকে মদত দিয়ে অবরোধ করিয়েছে।
যদিও অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার বিরোধী দলনেতা চিত্ত বিশ্বাস বলেন, “এটা তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদের ফল। জমি কে দখল করবে, তা নিয়েই অশান্তি। আমাদের এর মধ্যে জড়ানোর কোনও কারণ নেই।” বিজেপির তরফেও অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy