চলছে জমি পুনরুদ্ধারের কাজ। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ডানকুনি টোলপ্লাজার কাছে ছবি তুলেছেন দীপঙ্কর দে।
চাষজমির রক্ষার লড়াই এক সময়ে সিঙ্গুরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রাজ্য তথা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ধাক্কায় পরে জমি অধিগ্রহণ আইনে পরিবর্তন আনা হয়। তৃণমূল সরকার তো জানিয়েই দিয়েছে, কোনও কারণেই তারা চাষির থেকে জমি নেবে না। ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নের প্রশ্নে জমি পেতেও কালঘাম ছুটছে।
এই পরিস্থিতিটাকেই নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগাচ্ছে ডানকুনির ভূমি মাফিয়ারা। কলকাতার নাকের ডগায় ডানকুনি শিল্পাঞ্চলে জমির চাহিদা যথেষ্ট। সেই সুযোগে জমি কারবারিরা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের থেকে চড়া দাম হাঁকছেন। ছলেবলে কৌশলে চাষিদের থেকে ঘুরপথে জমিও কিনছেন। ডানকুনি অঞ্চলের এক চাষির আক্ষেপ, “রাজ্যে চাষির স্বার্থে জমি আন্দলোন করে শাসকদল ক্ষমতায় এল। আর এখন ডানকুনি অঞ্চলে সেই শাসকদলের লোকেদের দাপটেই চাষি জমি দিতে বাধ্য হচ্ছেন।”
সেই দাপটের মধ্যমণি কারা?
এলাকার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, দাপটের কেন্দ্রবিন্দুতে শাসকদলের কেষ্টবিষ্টু ছাড়াও রয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ। তাঁদের স্নেহছায়ায় এখন ডানকুনি লাগোয়া পাঁচটি মৌজায় জমি ব্যবসার অন্তত পাঁচ-ছ’টি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সব সিন্ডিকেটের মাথায় রয়েছেন শাসকদলের লোকজন। জেলার এক বিধায়কের নিকটাত্মীয় এখন জমি ব্যবসার মধ্যমণি। ডানকুনি শহর তৃণমূলের এক দাপুটে নেতাও সরাসরি কারবারে রয়েছেন। নৈটি পঞ্চায়েতের এক কর্তাব্যক্তি এবং ওই অঞ্চলের এক উপপ্রধানও সরাসরি কারবারে জড়িত রয়েছেন বলে দলের অন্দরে অভিযোগ। আর এইসব মাথাদের যোগফলেই চলছে দাপিয়ে জমির ব্যবসা।
পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে অবধারিত ভাবেই এক শ্রেণির দুষ্কৃতীদের সাহায্য নিচ্ছেন এই সব নেতারা। স্থানীয় সূত্রের খবর, গারদের আড়াল থেকেই হুগলির ত্রাস রমেশ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে। আবাসন প্রকল্পের পুরোটাই দেখভাল করছে তার দলবল। কেউ সোজাপথে জমি দিতে না চাইলে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা, জমির দরদাম ঠিক করা, আগ্রহীদের ব্যাঙ্কঋণ করে দেওয়ার আশ্বাস সবই। বিভিন্ন নামের প্রকল্পে জমির অবস্থান অনুয়ায়ী দামও ভিন্ন ভিন্ন। তার জন্য সুদৃশ্য দামের ক্যাটালগও রয়েছে। নেপথ্যে রমেশ থাকায় চাষি এবং শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা ভয়ে ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারেছেন না। কেউ বেঁকে বসলেও অনেক ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে রাজি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। চাপে পড়ে মাস কয়েক আগে এক চাষি আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গাড্ডায় পড়ে গিয়েছেন ব্যবসায়ীরাও। ডানকুনি লাগোয়া একশো বিঘে জমির উপরে এক গুচ্ছ কারখানা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন বেশ কিছু শিল্পপতি। রাজ্যের একটি অগ্রণী বিস্কুট সংস্থারও মালিকেরাও রয়েছেন তাঁদের তালিকায়। জমিজট এবং হাইকোর্টে মামলার জোড়া ধাক্কায় সেই সব প্রকল্পের কাজই আপাতত বন্ধ। প্রশাসনের একটি সূত্রের খবর, ওই এলাকায় বিস্কুট বাদেও জাহাজে ব্যবহৃত রঙ, আটা-ময়দা,অফসেট প্রিন্টিং প্রেস, ল্যামিনেশন, প্লাস্টিক কনটেনার কারখানা এবং বেশ গুদাম তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিক তাপস আদকের আক্ষেপ, “কাজকর্ম চলায় আমাদের রোজগার হচ্ছিল। এখন সব বন্ধ। একশোর বেশি শ্রমিক কাজ হারালাম।” শেখ সালাউদ্দিন নামে আর এক শ্রমিক বলেন, “এই অংশটা জলা জমি। চাষ হয় না। বর্ষায় জমি চার ফুট জলের নীচে থাকে। কারখানার কাজ করছিলাম। মামলা হওয়ায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।”
ডানকুনি অঞ্চলে ঠিক কী চলছে তা জানতে হাইকোর্ট রিপোর্ট তলব করায় চাপে পড়ে হুগলি জেলা প্রশাসন অবশ্য এখন নড়েচড়ে বসেছে। মাস কয়েক আগে সিঙ্গুরের বিএলএলআরও প্রবাল বাগাল নিজামপুর মৌজায় দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে জমি ভরাট করার অভিযোগ করেন। বস্তুত, জমির ভাল দাম থাকায় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের একাংশও এখন জমি কেনাবেচার ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। শিল্পের প্রয়োজনের চেয়ে বাড়তি জমি কিনছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। তার পর সুযোগ বুঝে চড়া দর হাঁকছেন। ডানকুনি শিল্পাঞ্চলে এক পাথর ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সরাসরি এ রকম অভিযোগ উঠেছে।
এক সময়ে পাঁচঘরা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, বর্তমানে উপপ্রধান তৃণমূলের অলীক আদকের নামেও দলের ভিতরে-বাইরে জমির ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। যদিও অলীকবাবু দাবি করেন, “জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই আমি সবার নিশানা হয়ে গিয়েছি। আমাদের পঞ্চায়েত এলাকায় কোথাও কোনও অভিযোগ পেলেই আমি বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনি। ব্যবস্থা নিই। সেই জন্যই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হচ্ছে। আমি যে কোনও তদন্তের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।”
অলীকবাবুর মতো শাসকদলের বেশ কিছু নেতা যে সরাসরি জমি ব্যবসায় জড়িত, তা কিন্তু এলাকায় প্রায় কারওরই অজানা নেই। জেলাশাসক মনমীত নন্দা বলেন, “মানুষকে সতর্ক করতে ডানকুনিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। যে সব জমি ভরাট করা হয়েছে তা চিহ্নিত করে মেশিনের সাহায্যে ফ্লাইঅ্যাশ তোলার কাজও হয়েছে। বেআইনি কিছু হলে প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ করবে।”
সেই পদক্ষেপের অপেক্ষাতেই এখন ডানকুনির আম আদমি। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy