Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

সুলতানের থেকে মুখ ঘোরাবে মানুষ, আশায় বিরোধীরা

একচল্লিশ ডিগ্রির দাপটে শহর যখন কাতর, তখন শেরপুরের চাষিদের উদ্বেগ, রোদ পড়ে না যায়। আমতা ব্লকের গ্রামে পুরুষরা কাটা ধান বান্ডিল করছেন। শাড়ি-ব্লাউজের উপর ফুলহাতা শার্ট চাপিয়ে মাথায় দু’টো-তিনটে বান্ডিল নিয়ে ছুটছেন মেয়েরা। আলের আশেপাশে সাপ অনেক। বিষধর সাপও আছে। তবু খালি পায়ে কাদা মাড়াচ্ছেন দিব্যি। তা বলে দেওয়াল লেখার ঝুঁকি নেননি ওঁরা।

স্বাতী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৮
Share: Save:

একচল্লিশ ডিগ্রির দাপটে শহর যখন কাতর, তখন শেরপুরের চাষিদের উদ্বেগ, রোদ পড়ে না যায়। আমতা ব্লকের গ্রামে পুরুষরা কাটা ধান বান্ডিল করছেন। শাড়ি-ব্লাউজের উপর ফুলহাতা শার্ট চাপিয়ে মাথায় দু’টো-তিনটে বান্ডিল নিয়ে ছুটছেন মেয়েরা। আলের আশেপাশে সাপ অনেক। বিষধর সাপও আছে। তবু খালি পায়ে কাদা মাড়াচ্ছেন দিব্যি।

তা বলে দেওয়াল লেখার ঝুঁকি নেননি ওঁরা।

খোলা মাঠেও গলা নামিয়ে অমর রং, শ্যামল মণ্ডলরা বললেন, পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএমের হয়ে দেওয়াল লিখেছিলেন বলে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। এ বার গ্রামের সব দেওয়াল তৃণমূল দখল করেছে দেখেও সবাই তাই চুপচাপ। বাম প্রার্থী কে, নামটাও জানেন না ওঁরা। “দেখি, বুথে এজেন্ট দিতে পারে কি না। ভোটটা দিতে পারলে ঠিক জায়গায় দেব,” উদাস গলা শ্যামলের।

“আমতা, বাগনান আমাদের জেতা। কিন্তু ভোট হতে দিলে তো?” সিপিএমের তরুণ তুর্কি সাবিরুদ্দিন মোল্লার আফশোস। উলুবেড়িয়া উত্তর, আমতা, উদয়নারায়ণপুর তিনটে বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের সন্ত্রাস, রিগিং, বুথ জ্যামের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিল পঞ্চায়েত ভোটে। আমতা আর বাগনানের দু’টো করে ব্লকে তৃণমূল কর্মীরা ভোট গুনতেই দেননি বলে অভিযোগ। উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্র এলাকার ৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মাত্র আটটা পেয়েছিল বামেরা। উদয়নারায়ণপুরে গ্রাম পঞ্চায়েতের কোনও আসনে বিরোধীরা মনোনয়ন দিতে পারেনি। এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী আসছে। সেই ভরসায় বুক বেঁধে দিনে ২৫-৩০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ঘুরছেন উলুবেড়িয়া পুরসভার বিরোধী নেতা সাবির। তাঁর নালিশ, তৃণমূল হামলা করছে কর্মীদের উপর।

হামলার কথা তুলতেই চাঁদির মাঝামাঝি হাত চলে গেল প্রবীণ কংগ্রেসি অসিত মিত্রের। ওইখানটাই ফেটেছিল তৃণমূল কর্মীদের বাঁশের ঘায়ে। জয়পুরের আজানগাছিতে কংগ্রেস সমর্থকদের ৪১টা বাড়ি পুড়েছিল। তা দেখতে গিয়ে কোপের মুখে পড়েন আমতার বিধায়ক, এ বার লোকসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থী প্রবীণ অসিতবাবু। “তবে মারটা আমার উপর দিয়ে গেল বলে ওর কাছাকাছি সিপিএম সমর্থকদের বাড়িগুলো বেঁচে গেল। নইলে ওগুলোও পুড়ত।” তৃণমূলের ‘টরচার আর তোলাবাজি’ মানুষ মানবে না, সেই ভরসায় নড়বড়ে ম্যাটাডরে, আগে-পিছে মাইক-লাগানো অটো নিয়ে ঘুরছেন অসিতবাবু। করাতবেড়িয়া নিমতলা বাজারের একখানা ঘরে তাঁর দলীয় অফিসঘর। একটি তক্তপোশ, গুটি কয়েক প্লাস্টিকের চেয়ার, খুদে টিভি, দড়িতে ঝোলানো লুঙ্গি, টি-শার্ট। ফিনফিনে প্লাস্টিক কাপের চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “টাফ ফাইট। আমাদের লোকজন ওরা নিয়ে নিয়েছে। টাকা জোগাড়েও সমস্যা।” খাস উলুবেড়িয়া শহরে ফ্লেক্স, পতাকা, দেওয়াল-লিখনে তৃণমূলের বহু পিছনে পড়ে কংগ্রেস। তবে ভোট ঠিকমতো হলে কংগ্রেসের খাসতালুক উদয়নারায়ণপুরে ভাল করবেন অসিতবাবু, আশা স্থানীয় কর্মীদের।

“ওদের কর্মীরা তো এখন আমাদের দলে। কে কাজ করবে, কে এজেন্ট হবে?” প্রশ্ন করলেন সুলতান আহমেদ। সুলতানের ‘প্লাস পয়েন্ট’ জনসংযোগ। গত পাঁচ বছর এলাকার কোনও আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেননি। টিউবওয়েল উদ্বোধনেও হাজির, বিয়েশাদিতেও। প্রাক্তন বাম সাংসদ হান্নান মোল্লার চাইতে এ দিক থেকে সুলতান যে অনেকটা এগিয়ে, তা এলাকার অনেকেই স্বীকার করলেন। নেতা-বিধায়কদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়াতে সরাসরি কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। যা ছিল বামসর্বস্ব, সেই উলুবেড়িয়ায় এখন বুথ স্তর পর্যন্ত তৃণমূলের মজবুত সংগঠন। ভক্তরা বলে, সুলতানের কাছে এসে কেউ খালি হাতে ফিরে যায় না। নিন্দুকেরা বলে, টাকা ছড়িয়ে ক্লাবগুলোকে হাত করেছেন সাংসদ।

তিনি নিজে কী বলেন? রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে বছরখানেক উলুবেড়িয়ার যদুবেড়িয়ায় ভাড়া বাড়িতে থাকছেন। অফিসঘরটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। বসতেই এল ঠান্ডা গ্লাসে সফ্ট ড্রিংক। “কেবল কাজ দেখালে হয় না, মুখ দেখাতে হয়,” বললেন সুলতান। তাঁর চকচকে প্রচার-পুস্তিকায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকা পাওয়া ১৫৩ জনের তালিকা। “কত লোককে সার্টিফিকেট দিয়েছি। ইজ্জত কার্ড করে দিয়েছি।”

এই কি সাংসদের কাজ? উলুবেড়িয়ার শিল্প চলছে খুঁড়িয়ে। সাড়ে আট হাজার কর্মী নিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাউড়িয়া কটন মিল। তখন অবসরের তিন মাস বাকি ছিল সুধীর দত্তের। আজ ৭৩ বছরে পেটের দায়ে চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। বকেয়াও মেলেনি। বাউড়িয়ার কেব্ল কারখানা খুলবেন, প্রতিশ্রুতি দেন সুলতান। “তার পর পাঁচ বছরে সে কথা এক বারও শুনিনি,” আক্ষেপ করলেন সুনীল আদক। সম্প্রতি কারখানার বন্ধ গেটের কাছে মিটিং করে গেলেন সুলতান। সমর্থকদের ভিড়ে কাছে ঘেঁষতে পারেননি সুনীলবাবুর মতো কর্মহীন শ্রমিকরা। উলুবেড়িয়ার রেল ওভারব্রিজ হয়নি। রেলগেটে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বলে বিরক্ত বিক্রেতারা চলে যাচ্ছেন অন্য আড়তে, জানালেন এলাকার এক বড় চাল ব্যবসায়ী।

“শিল্প আমার বিষয় নয়,” সাফ বললেন সুলতান। “মানুষ ইমিডিয়েট রিলিফ চায়।” বিদ্যুৎ, রাস্তা নিয়ে কিছু ‘সাফল্য’ তুলে ধরলেও আমজনতার দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে তিনি ‘কাছের মানুষ, কাজের মানুষ’ হতে চান। এর একটা নামও দিয়েছেন সুলতান, “মাইক্রো-সার্ভিস।”

কিন্তু মাইক্রো-ক্রাইম?

কান না-পেতেই শোনা যাচ্ছে অবাধ তোলাবাজি, চাঁদার জুলুম, ঘুষ আদায়ের অভিযোগ। এক ব্যবসায়ী জানালেন, নতুন নির্মাণে বর্গফুট-পিছু ১০-১৫ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। নার্সিংহোম মালিকের আক্ষেপ, মদ্যপ গুন্ডাদের ভাঙচুরের রেকর্ড সিসিটিভি থেকে বার করে দিলেও পুলিশ ধরেনি ওই দুষ্কৃতীদের। তৃণমূলের দাদাকে দিয়ে ফোন করাতে হয়েছে থানায়। চাঁদার অঙ্ক, চাঁদা আদায়ের লোক, পাঁচ বছরে দশগুণ বেড়ে গিয়েছে।

“ভেরি পুওর পোলিসিং” বললেন বিজেপি প্রার্থী রঞ্জিতকিশোর মহান্তি। ১৯৭৪ সালে তাঁর পুলিশের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন উলুবেড়িয়াতেই। অবসর নেন ডিজি-সিআইডি পদে। সাংবাদিকের কাছে কতটা বলা চলে, তা ভেবে থমকালেন এক মুহূর্ত। তার পর উলুবেড়িয়ার বিজেপি প্রার্থী বললেন, “লিখেই নিন। সুশীল পাল হত্যা মামলার তদন্ত আমিই করেছিলাম। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাকে ফোন করে বললেন, “আপনি অভিযুক্তদের ধরছেন না কেন? আমি জানি ওরা আমার পার্টির লোক। তাতে কিছু আসে-যায় না।”

সিআইডি-র পেশ করা প্রমাণের ভিত্তিতেই সদ্য সাজা হয়েছে ১২ জনের। রঞ্জিতবাবুর পকেটের চিরকুটে এখন পাঁচ জনের নাম। আমতার মুক্তিরচক গ্রামের গণধর্ষণে অভিযুক্ত। “এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। উলুবেড়িয়ার বিরোধীরা ভরসা খুঁজছেন এ ভাবেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE