শান্তির বারি। —নিজস্ব চিত্র।
ভোট বড় বালাই! মাথায় ভরা চৈত্রের প্রখর রোদ। সাদা পাঞ্জাবি ভিজে জবজবে। শাড়ির আঁচল কিংবা তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে জেরবার। অথচ মুখ থেকে হাসিটুকু সরলে চলবে না।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তুলনায় কম বেগ দিচ্ছেন না সূয্যিদেব। ভোটের বাজারে কি করে নাছোড়বান্দা গরমের মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করতে হচ্ছে প্রার্থীদের। রাস্তায় বেরিয়ে কারও হাতিয়ার ডাব, ওয়ারএস। হাতের তোয়ালেতে মুখ মুছে কেউ ঢক ঢক করে টিউবওয়েলের জল গলায় ঢালছেন। দুুপুরে কারও পছন্দ মৌরলা মাছের টক বা আমের ডাল। কেউ আবার শেষ পাতে চেটেপুটে খাচ্ছেন টকদই। ঘর্মাক্ত শরীরে দু’দণ্ড কোনও রকম জিরিয়ে নিয়েই ফের চলছে প্রচারে পথ-হাঁটা।
শ্রীরামপুরের সিপিএম প্রার্থী তীর্থঙ্কর রায় এ বারেই প্রথম লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। সিপিএমের নবীন প্রজন্মের এই প্রার্থী নাম ঘোষণা হওয়া ইস্তক চরকি পাক খাচ্ছেন। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে প্রচার শুরু করছেন। বাড়ি থেকে বেরচ্ছেন ছাতু খেয়ে। আর পথেঘাটে গরমের মোকাবিলায় থাকছে ওয়ারএস। গ্লুকোজ মেশানো জলও খাচ্ছেন। কর্মীরা ভালবেসে ডাব এগিয়ে দিলে না করছেন না। ঘণ্টা চারেক প্রচার চালিয়ে কোনও কর্মীর বাড়িতে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম। দুপুরের মেনুতে ডাল, ভাত, তরকারি, মাছের সঙ্গে টকদই অবশ্যই হাজির থাকছে।
শ্রীরামপুর কেন্দ্রটি ধরে রাখতে তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও কম দৌড়চ্ছেন না। সকাল সকাল প্রচারে বেরনোর আগে ব্রেকফাস্ট সারছেন দুধ-কর্নফ্লেক্স দিয়ে। আর জোর দিচ্ছেন তরমুজের উপর। রোদ একটু চড়লেই মাথায় উঠে আসছে সাদা টুপি। ঘণ্টা চারেক টানা প্রচার চালিয়ে ক্ষণিকের বিশ্রাম। সেখানে জল বা ডাবের উপরে ভরসা রাখছেন। তবে তীব্র গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও ঠাণ্ডা জল ভুলেও ছুচ্ছেন না। পাছে গলা বসে যায়! বেলা ১২টা নাগাদ একটু আম দিয়ে তৈরি সফট ড্রিংক গলায় ঢালছেন। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ভুলেও ঢুকছেন না। দুপুরে টকের ডাল, মৌরলা মাছের টক তাঁর মনপসন্দ। মঙ্গলবার উত্তরপাড়ায় প্রচার সেরে সেরে টক ডাল, পোস্ত আর কাতলা মাছের ঝোল দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারেন তিনি। শেষ পাতে দই। গরমে ধকল কম হচ্ছে না। গত রবিবার সন্ধ্যায় প্রচার সেরে কল্যাণবাবু উত্তরপাড়ার মালিকপাড়া অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে গিয়েছিলেন নৈশালোকে ফুটবল দেখতে। মাঠের ধারে বসে খেলা দেখতে দেখতে কাধে ম্যাসাজ নিতে দেখা গেল তাঁকে।
এখানে পোড়খাওয়া কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুল মান্নান প্রচারে বেরিয়ে শুধু জল খাচ্ছেন। রবিবার সকালে বেরিয়েছিলেন শ্রীরামপুরের নয়াবস্তিতে। গনগনে রোদ্দুর আটকাতে হুডখোলা জিপে ছাতা লাগিয়ে চলল প্রচার। মান্নান দুপুরে ভাত, সব্জি, মাছের সঙ্গে দই খাচ্ছেন। মাস কয়েক আগে পা ভেঙেছিল। সময় করে তাই ফিজিওথেরাপি করাতে হচ্ছে নিয়মিত। ‘ডিস্কো কিং’ বাপি লাহিড়ীর দুপুরের মেনুতে ডাল, ভাতের সঙ্গে টক দই হাজির থাকছে। সকালে খাচ্ছেন কর্নফ্লেক্স আর ফল।
হুগলির সিপিএম প্রার্থী প্রদীপ সাহা প্রচারে বেরিয়ে সঙ্গী করছেন ‘পানামা হ্যাট’। রোদ্দুর থেকে বাঁচতে এটাই তাঁর মোক্ষম অস্ত্র। মঙ্গলবার তালাণ্ডুতে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে চোখেমুখে জলের ছিটে দিতেও দেখা গেল বার কয়েক। এই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রত্না দে নাগ নিজে চিকিৎসক। প্রচারে বেরিয়ে তিনি ভরসা রাখছেন ডাব আর জলের উপরে। চা চলছে মাঝেমধ্যে। এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী চন্দন মিত্রও মাথায় টুপি পড়ছেন। ভ্যাপসা গরমে সঙ্গে থাকা জল কিছু ক্ষণের মধ্যেই তেতে যাচ্ছে। চন্দনবাবুর সঙ্গে প্রচারে বেরনো দলীয় কর্মীরা তাই টিউবওয়েল দেখলেই বোতল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। দিন কয়েক আগে বলাগড়ে গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাইয়েছিলেন এক গ্রামবাসী। সেই স্বাদ নাকি এখনও মুখে লেগে আছে!
আরামবাগেও প্রবল গরমে মাইলের পর মাইল ঘুরে প্রার্থীদের মুখের হাসি অবশ্য অমলিন। মানুষের বাড়িতে পরম তৃপ্তিতে তাঁরা সরবত বা বাতাসা-জল খাচ্ছেন। সিপিএম প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক সকাল ৭টায় রুটি-তরকারি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে প্রচারে বেরোচ্ছেন। রোদ্দুরকে থোড়াই কেয়ার প্রবীন এই স্কুল-শিক্ষকের। এই তো সে দিন খানাকুলের মোস্তাফাপুরে ছাতা এগিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয় কমরেডরা। তিনি স্রেফ ‘না’ বলে দিয়েছেন। “গাঁয়ের মানুষ। প্রখর রোদ আমার গা-সওয়া” সাফ কথা শক্তিমোহনের। শরীরের উপর বিশেষ যত্ন নেওয়া তাঁর নাকি ধাতে নেই! খাবারেও তেমন বাছবিচার কই! দুপুরে দলীয় কার্যালয় বা কোনও কমরেডের বাড়িতে ভাতের সঙ্গে টক ডাল, আলু পোস্ত, মাছ বা টমেটোর চাটনিতেই তাঁর রসনা তৃপ্ত। আরামবাগের বিজেপি প্রার্থী মধুসূদন বাগ বা কংগ্রেসের শম্ভুনাথ মালিকেরও দাবি, রোদ্দুর নিয়ে তাঁরা বিব্রত নন।
রোদ্দুরকে বুড়ো আঙুল দেখাতে আরামবাগের তৃণমূল প্রার্থী সকালে প্রচারে বেরনোর আগে মুখে সানস্ক্রিন লোশন মেখে নিচ্ছেন। হালকা রঙের শাড়ি পড়ছেন। তবে সানগ্লাস থাকলেও বের করছেন না। পাছে গাঁ-গঞ্জের মানুষ কিছু মনে করে বসেন! মুখে বলছেন, “আমি সাধারণ পরিবারের মেয়ে। খাবার নিয়ে বাছবিচার নেই। যা পাই তা-ই খাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy