—প্রতীকী ছবি।
তুমুল কথা কাটাকাটি ধাবায়। ক্রেতার বক্তব্য, ‘‘এত দিন দিয়ে এসেছেন। আজ কেন দেবেন না?’’ ধাবার ছেলেটা যত বোঝানোর চেষ্টা করছে, ক্রেতার সুর সপ্তমে চড়ছে। রুটি-ডাল মাখানির সঙ্গে ওই এক টুকরো পেঁয়াজে চলে না। তাঁকে আরও এক টুকরো দিতে হবে! ঝামেলা হচ্ছে দেখে ছুটে আসেন ধাবার মালিক। তিনিও ক্রেতাকে নিজের অপারগতা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বিশেষ লাভ হল না। দীর্ঘ দিনের খদ্দের ওই প্রৌঢ় ক্রেতার ‘হুজ্জুতি’তে হার মানলেন তিনিও। আরও এক টুকরো পেঁয়াজ তাঁকে দিতেই হল!
এটা শুধু মুর্শিদাবাদের পলসন্ডার একটি ধাবার ঘটনা নয়। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ সংযোগকারী ৩৪ নম্বর জাতীয় স়ড়কের দু’ধারের প্রায় সব ধাবার মালিকদেরই প্রত্যেক দিন এই সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। একই চিত্র মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তরাঁতেও। দাম ১০০ ছুঁইছুঁই হওয়ায় খাবারের সঙ্গে এখন ‘ফ্রি’তে পেঁয়াজ বিলোতে গিয়ে মাথায় হাত মালিকদের। অন্য দিকে, ক্রেতারাও নাছোড়। কাঁচা পেঁয়াজ ছাড়া রুটি-তড়কা বা ডাল মাখানির স্বাদ অধরা যে!
পলসন্ডায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’ধারে অনেকগুলি ধাবা রয়েছে। রাতে সেই ধাবাতেই খেতে আসেন ট্রাক চালকেরা। অন্যান্য সময়ে ধাবার কর্মীরাই জানতে চাইতেন, আর পেঁয়াজ লাগবে কি না। মূল্যবৃদ্ধির দাপটে সেই ‘বিনয়’ মাথায় উঠেছে। আর এক ধাবার মালিক যশপ্রীত সিংহের কথায়, ‘‘সপ্তাহ দুয়েক আগেও খাবারের সঙ্গে দেওয়ার জন্য ৪০ কেজি ও রান্নার জন্য এক কুইন্টাল পেঁয়াজ কেনা হত। এখন সব মিলিয়ে ৬০ কেজি কেনা হচ্ছে।’’ সব জেনেও পরিস্থিতির সঙ্গে আপোস করতে নারাজ ক্রেতারা। রাতে যশপ্রীতের ধাবাতেই খেতে এসেছিলেন রাজস্থান থেকে আসা উধরম সিংহ চৌহান। তিনি বলেন, ‘‘তড়কা-রুটির সঙ্গে পেঁয়াজ ছাড়া চলে না। এরা আগে কিছু বলছে না। খাবার দেওয়ার পর আবার পেঁয়াজ চাইলেই কেমন না-শোনার ভান করে চলে যাচ্ছে। আগে জানলে এখানে খেতাম না।’’
মুর্শিদাবাদের এই সব ধাবাগুলি পেঁয়াজ কেনে মূলত বহরমপুরের পাইকারি বাজার থেকে। ধাবার মালিকেরা জানাচ্ছেন, পাইকারি বাজারেই এখন কেজি প্রতি ৮০ টাকায় বিকোচ্ছে পেঁয়াজ। খুচরো বাজারে তা প্রায় ১০০ টাকা! যা তাঁদের সাধ্যে কুলোচ্ছে না। এক ধাবার মালিক সুখবিন্দর সিংহ বলেন, ‘‘আগে ক্রেতারা যতটা চাইতেন, ততটাই পেঁয়াজ মিলত। কিন্তু যে ভাবে দাম বেড়েছে, তাতে আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে ওই এক টুকরো পেঁয়াজই দিতে হচ্ছে।’’
শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, গোটা রাজ্য জুড়েই এই পরিস্থিতি। গত সপ্তাহে কলকাতার বাজারে যে পেঁয়াজ ৪০ টাকা প্রতি কেজিতে বিক্রি হচ্ছিল, তার দাম এখন দ্বিগুণ। বৃহস্পতিবারই মানিকতলা, উল্টোডাঙা, কলেজ স্ট্রিট, গড়িয়াহাট, ল্যান্সডাউন, লেক মার্কেটের মতো বাজারে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে এক কেজি পেঁয়াজ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে আবার পেঁয়াজের দাম তিন গুণ বেড়েছে। ক’দিন আগে পর্যন্ত এক কেজি পেঁয়াজ ২০-২৫ টাকায় পাওয়া যেত। এখন তা ৭৫-৮০ টাকা। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত, দেগঙ্গা, আমডাঙা, দত্তপুকুর, বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, হঠাৎ দাম বৃদ্ধিতে দরদাম করে অনেকেই পেঁয়াজ না কিনে ফিরে যাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গেও একই হাল। কোচবিহারে পেঁয়াজ ৭০ টাকা, মালদহ, দুই দিনাজপুর ও নদিয়ায় ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাংলায় পেঁয়াজের জোগান দেয় মহারাষ্ট্র ও কর্নাটক। এক সপ্তাহে এতটা দামবৃদ্ধির কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীদের একাংশ জানাচ্ছেন, চাহিদার তুলনায় জোগান কমে যাওয়ার ফলেই দাম এত বেড়ে গিয়েছে। সরবরাহকারী দুই রাজ্যে অনাবৃষ্টির কারণে খরিফ বা বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চাষে বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান কম। মজুতও ফুরিয়ে এসেছে। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল চাষি ভেন্ডর অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি তথা রাজ্য টাস্ক ফোর্সের সদস্য কমল দে-র যুক্তি, ‘‘উৎসবের মরসুম হওয়ায় ভিন্রাজ্য থেকে আসা পেঁয়াজভর্তি গাড়ি কলকাতার বাইরে আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে গাড়ি শহরে ঢোকার আগেই ৭০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কমার এটা একটা বড় কারণ।’’
এ রাজ্যেও পেঁয়াজ চাষ হয়। মূলত হুগলি, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানে। জেলার চাষিরা জানাচ্ছেন, মূলত সুখসাগর প্রজাতির পেঁয়াজ চাষ হয় এখানে। সেই পেঁয়াজ বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। উৎপাদনের পর মাস পাঁচেক সেই পেঁয়াজের জোগান থাকে বাজারে। মুর্শিদাবাদের এক ব্যবসায়ী শুভাশিস মণ্ডল বলেন, ‘‘চাহিদা এবং জোগানের উপর দাম ওঠা নামা করে। এখন জোগান কম থাকায় দাম বেড়েছে। পেঁয়াজ জানুয়ারি মাসে উঠলেই দাম কমবে। বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ অল্প পরিমাণ জমিতে হয়। তাই চাহিদা মেটে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy