Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪

আতর-সুর্মা-জর্দা ফেরাতে এ বার ব্র্যান্ড চিৎপুর

সে ছিল এক কলকাতা, যখন শৌখিন বাবুয়ানি চিৎপুরের বাছাই করা আতরের খুশবুতে মাতোয়ারা হতো। নবাবজাদাদের পাশাপাশি অমীর-মেজাজ বাঙালিবাবু গিলে করা পাঞ্জাবীর হাতায় সেই সুগন্ধের ছোঁয়া নিয়ে ফিটন গাড়িতে গঙ্গাপাড়ে হাওয়া খেতে যেতেন, রাত কাটাতেন বাঈজিবাড়ির মেহফিলে।

সুরভিত: চিৎপুর এলাকায় একটি আতরের দোকান। নিজস্ব চিত্র

সুরভিত: চিৎপুর এলাকায় একটি আতরের দোকান। নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৭ ০১:৪২
Share: Save:

সে ছিল এক কলকাতা, যখন শৌখিন বাবুয়ানি চিৎপুরের বাছাই করা আতরের খুশবুতে মাতোয়ারা হতো। নবাবজাদাদের পাশাপাশি অমীর-মেজাজ বাঙালিবাবু গিলে করা পাঞ্জাবীর হাতায় সেই সুগন্ধের ছোঁয়া নিয়ে ফিটন গাড়িতে গঙ্গাপাড়ে হাওয়া খেতে যেতেন, রাত কাটাতেন বাঈজিবাড়ির মেহফিলে। সুর্মাটানা মায়াবী চোখ উঁকি দিয়ে যেত জাফরিকাটা বারান্দায় কিংবা ঘোমটার আড়াল থেকে।

সময় বদলাল। চিৎপুরের পুরনো বাড়ি, ট্রাম লাইন, ঘুপচি রাস্তা থেকে গেলেও ফিটন-বাঈজিনাচ-বাবু কালচারের মতোই হারিয়ে গেল বাঙালির আতর-মুগ্ধতা আর সুর্মা-প্রেম। ব্যবসা গুটিয়ে নিতে থাকলেন একের পর এক আতর-সুর্মা কারবারি। শহরের একটা প্রান্ত থেকে কয়েক শতাব্দী পুরনো গোটা একটা ঐতিহ্য উবে যেতে লাগল।

বিষয়টা ভাবিয়েছিল রাজ্যের অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও বস্ত্র দফতরের অন্তর্গত বিশ্ব বাংলা মার্কেটিং কর্পোরেশনের কর্তাদের। বাংলার হারিয়ে যাওয়া শিল্প, সংষ্কৃতি, ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন এবং নতুন আঙ্গিকে তার বিপণন নিয়েই তাঁদের কাজ। পুরনো চিৎপুরের অলিগলিতে শুরু হয়েছিল খোঁজ। প্রকৃত কারিগর পরিবারগুলিকে চিহ্নিত করা, তাঁদের সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা। বিশ্ব বাংলার বিপণিগুলিতে ‘চিৎপুর’ ব্র্যান্ড-এ শুরু হয়েছিল খাস চিৎপুরের আতর, আতরের তৈরি সাবান, সুর্মা, গোলাপ জলের বিক্রি। তাতেই দু’বছরের মধ্যে কিস্তিমাত।

বিশ্ব বাংলার শোরুমগুলির পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৪-’১৫ সালে ১৭ লক্ষ টাকার আতর বিক্রি হয়েছিল। ২০১৬-’১৭ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪০ লক্ষ টাকা। আতরের সুগন্ধী সাবান ২০১৪-’১৫ সালে বিক্রি হয়েছিল ৪৪ হাজার। গত আর্থিক বছরে তা হয়েছে ১০ লক্ষ! সুর্মার বিক্রি বছরে ৮৮ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষে। গত দু’বছরের চিৎপুরের আতরের চাহিদা ৫৪% ও সুর্মার চাহিদা ৯৪% বেড়েছে। এই সাফল্য দেখে চিৎপুরের জর্দা আর গিলে করা পাঞ্জাবীর ঐতিহ্যকেও উদ্ধার করা নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েক ঘর শিল্পীকেও চিহ্নিত করা হয়েছে যাঁরা বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে এসেছেন।

আরও পড়ুন:সন্তান নেই, তাই কিনেছি, কবুল শিক্ষক দম্পতির

বিশ্ব বাংলার চিফ অপারেশন অফিসার স্নেহাশিস সরকারের কথায়, ‘‘আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল আতর-সুর্মার খাঁটি শিল্পী পরিবারগুলিকে খুঁজে বার করা। যাঁরা শত চাপেও আতর বা সুর্মা তৈরির আদি পন্থা অক্ষুণ্ম রেখেছেন। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল, বিক্রি বাড়ানো। এখন তো বিদেশ থেকে এত অর্ডার পাচ্ছি যে দিয়ে কুলনো যাচ্ছে না।’’

চিৎপুরের যে প্রধান দুই কারিগর পরিবারের সঙ্গে সরকার যুক্ত হয়েছে তারা হল, আল্লাবক্স পরিবার ও ফহিমউদ্দিন মদিনা আতর পরিবার। ১৮২৪-এ লখনউ থেকে এসে আতর-সুর্মার দোকান খোলেন হাজি খোদাবক্স নবিবক্স। ৮ প্রজন্ম ধরে তাঁরা ব্যবসা করছেন কলুটোলার একই জায়গায়। ফহিমুদ্দিনের দোকানেরও একশো বছর হতে চলল। ব্যবসা নিয়ে চিন্তা বাড়ছিল। মল্লিক বা ঠাকুরদের মতো কিছু পরিবারে এখনও এঁদের দোকান থেকে মাসকাবারি মালের সঙ্গে আতর, গোলাপজল, জর্দা যায়। কিন্তু সার্বিক ভাবে ব্যবসা মন্দা ছিল। ‘ব্র্যান্ড চিৎপুর’-ই আবার সেকালের সঙ্গে একালের কলকাতা মিলিয়ে আতরের খুশবু আর সুর্মার মায়া অটুট রাখল।

অন্য বিষয়গুলি:

Surma Perfume
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE