আনন্দবাজার পত্রিকা। ২৫ অগস্ট, ১৯৪৫।
শেষ পর্যন্ত ৬৪টি ফাইল-সমন্বিত পাহাড়ের মূষিক প্রসব।
কোথাও ১৯৪৬-এর ৪ মে গোয়েন্দা দফতর জানাচ্ছে, ‘‘গোপনে চিঠিপত্র পড়ার সময় একটি চমকপ্রদ ঘটনা নজরে এসেছে। শরৎচন্দ্র বসুকে ভিয়েনা থেকে এমিলি শেঙ্কল নামে এক ভদ্রমহিলা চিঠিতে জানিয়েছেন, তিনি সুভাষচন্দ্রের বিধবা স্ত্রী।’’
’৪৬ সালের ২১ নভেম্বর আর একটি পুলিশ রিপোর্ট। সেখানে জনৈক সোর্স জানিয়েছে, সুভাষচন্দ্র জার্মানিতে ফেলিক্স নামে এক জনের বাড়িতে থাকতেন। তাঁর স্ত্রী লুসি শ্যামবাজারের বাসিন্দা জনৈক দত্তকে জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী ও শাশুড়ি যুদ্ধে মারা গিয়েছেন। বিমান হানায় তাঁর স্ট্যাম্প সংগ্রহ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাই চিঠি লিখছেন।
স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে সুভাষচন্দ্রের জার্মান বাড়িওয়ালির স্ট্যাম্প কালেকশনটাও গুরুত্বপূর্ণ খবর বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একুশ শতকের বাঙালি? সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন কি না, মারা না গেলে সোভিয়েত রাশিয়া না মঙ্গোলিয়া কোথায় গিয়েছিলেন, সাধুর বেশে স্বদেশে ফিরেছিলেন কি না ইত্যাদি রোমাঞ্চকর গল্পেই তারা সারা দিন আচ্ছন্ন হয়ে থাকল। মাথা ঠান্ডা রাখল শুধু ইতিহাস মহল। নেহরু ও সুভাষের যুগ্ম জীবনীকার রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্ত— অনেক ইতিহাসবিদই বলছেন, ‘‘আগে ফাইলগুলো পড়ি।’’
৬৪টি ফাইল এক দিনে পড়া দুষ্কর। ডিভিডিতে এক-একটি ঢাউস ফাইল খুলতে ঘণ্টা কাবার। প্রতি পাতার ছবি তুলে দেওয়া হয়েছে। স্ক্যান করে ফাইলগুলির মেগাবাইট কমানোর কথা কেউ ভাবেননি। অতএব তাইহোকু-রহস্য আজও মেটেনি।
মেটার কথাও ছিল না। সুভাষচন্দ্র সোভিয়েত কারাগারে বন্দি ছিলেন, এমন একটি তত্ত্ব অনেক দিন ধরেই চালু। তিনি সত্যিই তা-ই ছিলেন কি না, জানতে ১৯৯৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার আর্কাইভ দেখতে গিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হরি বাসুদেবন। ‘‘সোভিয়েত কারাগারের তত্ত্বটা সত্যি কি না জানতে আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু কেজিবি বা ব্রিটিশ এম আই ফাইভের গোপন ফাইল আমাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। ওই সময়ে গোপন ফাইলে যুদ্ধসংক্রান্ত অনেক গোপন সঙ্কেত ছিল, ফলে কোনও দেশই সে সব দেখার অনুমতি দেয় না,’’ বলছেন তিনি। ফলে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে যদি সত্যি কোনও রহস্য থাকে, সেটি অন্তত রাজ্য পুলিশের ফাইলে উদ্ধার হওয়া মুশকিল।
এ দিনও মানিকতলা ডিসি অফিসে নেতাজির ভাইপো অমিয়নাথ বসুর পুত্র চন্দ্র বসুর দাবি, ‘‘একটা ফাইলে আছে ১৯৪৯-এ নেতাজি চিনে ছিলেন। সামরিক বাহিনী গঠন করে স্বাধীন ভারতে ফেরার প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন।’’ কিন্তু ইতিহাসবিদ লেনার্ড গর্ডনকে ৪০ বছর আগেই কেউ এই তত্ত্বটি দিয়েছিলেন। ‘ভারতপ্রেমিক যোদ্ধা কেন চিনা সেনাপতির ছদ্মবেশে থাকবেন? অনেক বলেও ভদ্রলোককে বোঝাতে পারিনি,’’ ‘ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ’ বইতে লিখেছিলেন লেনার্ড। ১০ নম্বর ফাইলে দেখাও গেল, অমিয়কে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের এক অফিসার ১৯৪৮ সালে লিখছেন, তাঁর বিশ্বাস নেতাজি জীবিত!
৫৮ নম্বর ফাইলে কিছু খবরের কাগজের কাটিং। সেখানে ১৯৫৩ সালে এক বাংলা কাগজ জানাচ্ছে, ভিয়েনায় এমিলি শেঙ্কল তামিলনাড়ুর বিধান পরিষদের সদস্য এস বি আদিত্যনকে জানিয়েছেন, সুভাষচন্দ্র বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হননি! আর একটি জায়গায় ১৯৪৯ সালে মুম্বইয়ের ব্লিৎজ পত্রিকার রিপোর্ট। আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামী অধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর বিমান দুর্ঘটনার গল্পটি ভুয়ো বলে সেখানে দাবি। ওই পাতাতেই রয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলনে সুভাষের হাত থাকতে পারে বলে ইংরেজ ও আমেরিকানদের বিশ্বাস। তিনি টিটো, দিমিত্রভ বা মাওয়ের মতো আঘাত হানার উপযুক্ত সময় খুঁজছেন। মহাযুদ্ধের পরে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ককে কমিউনিস্ট নেতা বানিয়ে দেওয়া হল!
আর একটি ফাইলে আবার দেখা গেল, ১৯৪২ সালে রয়টার্স এক বার সুভাষচন্দ্র বসুর ‘মৃত্যু’র খবর দিয়েছিল। একমাত্র হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সুরেশচন্দ্র মজুমদার সে খবর ছাপেননি, উল্টে তাঁর কাগজে লিখেছেন ‘আমরা এই শোকসংবাদ প্রত্যাখ্যান করি। সুভাষচন্দ্র বসু দীর্ঘজীবী হোন।’ একটি ফাইলে বাংলার রাজনীতির ট্রাডিশন: সুভাষচন্দ্রের অনুগামীদের রূঢ় ব্যবহারে ব্যথিত এক প্রার্থী কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। এই অনুগামীদের ব্যবহার সম্পর্কে রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়েও লাভ হয়নি। বাঙালির রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের কাছে এই সব ফাইল অবশ্যই মূল্যবান। যাঁরা রহস্যকাহিনি খুঁজবেন, তাঁদের কাছে হয়তো নয়।
ইতিহাসবিদরা বলেন, আম বাঙালি নেতাজিকে নিয়ে রহস্যে যত আগ্রহ দেখিয়েছে, তথ্যে তত নয়। অতঃপর শৌলমারীর সাধু ও অনেক বাবাজির কাহিনি। তাইহোকু রহস্য উদ্ঘাটনে তৈরি শাহনওয়াজ কমিটি চেন্নাইয়ের বিধায়ক এম থেভরের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। থেভর জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে নেতাজির নিত্য যোগাযোগ আছে। কমিটি কথা বলতে চাইল, কিন্তু তামিল বিধায়ক কথা বলতে অস্বীকার করলেন। ১৯৭০ সালে তৈরি খোসলা কমিটিতে শোলাপুরের পি এম কর্পুরকর বলেছিলেন, তাঁর শরীরের রেডিও অ্যান্টেনায় তিনি নেতাজির খবর পান। বিচারপতি খোসলা এ সব দাবি উড়িয়ে দিয়ে লিখলেন, ‘‘এই সবের পিছনে ব্যক্তিগত মোটিভ, অন্যের মনোযোগ টানাই আসল উদ্দেশ্য!’’
নেতাজি রহস্য নিয়ে বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আরও একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল। তারা তাইহোকুর ঘটনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল বটে, কিন্তু সে রিপোর্ট সংসদে খারিজ হয়ে যায়।
তাইহোকু নিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিন্নমত হয়েছিল শাহনওয়াজ কমিশনও। কিন্তু ঘটনা হল, গোড়ায় কমিশনের তিন সদস্যই নেমে নিয়েছিলেন যে তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়। পরে জল অন্য দিকে ঘুরল। কমিটির রিপোর্ট: প্রথমে একমত হয়েও পরে এক অজ্ঞাত কারণে সুভাষের ভাইপো সুরেশচন্দ্র বসু রিপোর্টে সই করেননি। সমর গুহ যে ছবিতে শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুর ধড়-মুন্ডু একত্র বসিয়ে নেতাজি বেঁচে আছেন বলে আওয়াজ তুলেছিলেন, সে সব লেনার্ড গর্ডনের বইতেই আছে। শিশির বসুর পরিবারের ওপর পুলিশি নজরদারির তথ্যও দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানা থেকে আগেই বেরিয়েছে। শিশির বসুর ছেলে, ইতিহাসবিদ সুগত বসু তখনও তাতে বাড়তি রহস্য খুঁজে পাননি। বলেছিলেন, ‘‘স্বাধীন দেশের নাগরিকের ওপর গোপন নজরদারি ছাড়া আর কোনও দোষে সরকারকে দোষী করা যায় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy