Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

এভারেস্ট ছুঁয়ে দেহ ফিরল ঘরে

স্বপ্ন পূরণ করে এভারেস্টের চূড়োয় পা রেখেছিলেন। কিন্তু সেই গর্বের কথা বলতে আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। বরফের দেশ থেকে নেমে এল কফিনবন্দি তাঁর নিথর দেহ।

অভিযাত্রী। বাঁকুড়ার মানুষ এ ভাবেই শেষ শ্রদ্ধা জানালেন বরফের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া ঘরের ছেলে সুভাষ পালকে। বুধবার বাঁকুড়া পুরভবনে ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

অভিযাত্রী। বাঁকুড়ার মানুষ এ ভাবেই শেষ শ্রদ্ধা জানালেন বরফের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া ঘরের ছেলে সুভাষ পালকে। বুধবার বাঁকুড়া পুরভবনে ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৬ ০২:০৬
Share: Save:

স্বপ্ন পূরণ করে এভারেস্টের চূড়োয় পা রেখেছিলেন। কিন্তু সেই গর্বের কথা বলতে আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। বরফের দেশ থেকে নেমে এল কফিনবন্দি তাঁর নিথর দেহ।

এভারেস্টজয়ী বাঁকুড়ার ছেলে সুভাষ পালের দেহ বাড়িতে পৌঁছনোর পর দেখা গেল, এই ক’দিনে তামাম বাঁকুড়াবাসীর যেন তিনি ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছেন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে বুধবার তাই মানুষের ভিড় ভেঙে পড়ল সারদাপল্লির মাঠে। সে টান এমনই যে বৃষ্টিও বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। সেখানে জেলা প্রশাসনের শীর্ষ আমলা থেকে নেতা, ছোট থেকে বড় সকলেই শেষবারের জন্য শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন।

ফুলের তোড়ায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ছেলের কফিনে হাত বোলাতে বোলাতে বাবা বৃদ্ধ ভক্তদাস পাল কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন— “যাওয়ার আগে ও বলেই গিয়েছিল ফিরে আসার পরে তাকে দেখতে ঘরে মানুষের ভিড় জমবে। ওর কথাটাই সত্যি হয়ে গেল। শুধু মানুষটাই আর থাকল না!’’

স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে, বাবার পেনশনের প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে এবং পড়শিদের কাছ থেকে টাকা ধার করে স্বপ্ন পূরণে বেড়িয়েছিলেন সুভাষবাবু। তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বাঁকুড়া জেলা পুলিশ থেকে সাধারণ বেশ কিছু মানুষজন। ৭ এপ্রিল তিনি বাঁকুড়া থেকে রওনা হন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, গত ২১ মে সুভাষ এভারেস্ট জয় করেন। কিন্তু তারপরেই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন তিনি। প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে শেষে হিমালয়ের বরফের বিছানাতেই তিনি দেহ রাখেন।

২৩ মে সেই খবর ছড়িয়ে যায়। সেই থেকেই শহরের অলিগলি থেকে রাজপথে সুভাষবাবুর নামে পোস্টার সাঁটিয়ে তাঁকে জেলার গর্ব হিসেবেই তুলে ধরেছেন মানুষজন। কাতারে কাতারে মানুষ সুভাষবাবুর পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে শেষ বারের মতো দেখতে অধীর হয়ে ছিলেন শহরবাসী। কাঠমাণ্ডু যান তাঁর দাদা। আর অধীর অপেক্ষায় থাকে বাঁকুড়া।

সুভাষ পালের ক্যামেরা থেকে সংগৃহীত এই দেখেই পর্বতারোহীরা জানাচ্ছেন, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু ফিরতে পারেননি। বাবার ছবিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে মেয়ে সুশ্রিতা।—নিজস্ব চিত্র

সুভাষবাবুর এভারেস্ট ছোঁয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ায় শোকের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। পরিজনেরা কিন্তু দাবি করতে থাকেন, তিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখর ছুঁতে পেরেছেন। কাঠমাণ্ডুতে তাঁর দেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসার পরে সঙ্গে থাকা ক্যামেরা খুলে দেখা যায়, তাঁদের দাবিই ঠিক। রাজ্যের যুব কল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা উজ্জ্বল রায়ও বুধবার দাবি করেন, ‘‘কাঠমাণ্ডুতে সুভাষের ক্যামেরা আমিই প্রথম খুলি। এভারেস্টে ওঠার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ওর ছবি দেখে আমি নিশ্চিত সুভাষ এভারেস্টে উঠেছিলেন। এ রকম অন্তত ১৫টি ছবি ক্যামেরায় রয়েছে।’’ তিনি জানান, এভারেস্টে ওঠার কৃতিত্বের জন্য নেপাল সরকারের শংসাপত্র পেতে সুভাষবাবুর এজেন্সি ছবিগুলি সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দিয়েছেন।

মঙ্গলবার রাতেই কলকাতা বিমানবন্দর থেকে সুভাষবাবু দেহ নিয়ে আসা হয় বাঁকুড়ায়। রাতে জেলা পুলিশ লাইনে রাখা হয় দেহ। বুধবার মানুষজন যাতে তাঁকে শেষবারের শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, সে জন্য প্রশাসন ও স্থানীয় মানুষ সারদাপল্লির মাঠে সব কিছু আয়োজন করে।

এ দিন ভোর থেকেই আকাশের মুখ ছিল ভার। দফায় দফায় বৃষ্টিও নামে। যদিও তাতে শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানে কোনও ছেদ পড়েনি। হাজার-হাজার মানুষ এ দিন মাঠে উপস্থিত হন। সকালে কয়েক ঘণ্টা সারদাপল্লির মাঠে তাঁর দেহ রাখার পরে তা নিয়ে শহরে শোকযাত্রা শুরু হয়। সুভাষবাবুর দেহ এনে বাঁকুড়া পুরভবনেও তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান পুরসভা কর্তৃপক্ষ। তাঁর দেহের সঙ্গে যেমন ভিড়, তেমনই রাস্তার দু’পাশে। কেউ ফুল ছুড়েছেন। কেউ মালা দিয়েছেন শববাহী গাড়িতে। শহর পরিক্রমার পরে সুভাষবাবুর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় গোবিন্দনগর সংলগ্ন বরুট গ্রামের শ্মশানে। সেখানেই তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়।

সারদাপল্লির মাঠে সুভাষবাবুর কফিনকে ঘিরে বসে ছিলেন তাঁর পরিবারের লোকজন। স্ত্রী বিশাখাদেবী শোকে ভেঙে পড়েন। তাঁকে বারবার সামলানোর চেষ্টা করে সুভাষবাবুর এগারো বছরের মেয়ে সুশ্রিতা। পাড়া-পড়শিরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি এ দিন। অনেকেই সুভাষবাবুর স্মৃতিচারণ করছিলেন।

তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এ দিন মাঠে এসেছিলেন জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু, জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের সুপার পঞ্চানন কুণ্ডু থেকে জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী, কংগ্রেস বিধায়ক শম্পা দরিপা, তৃণমূল জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ প্রমুখ। বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ দে-ও সুভাষকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন।

সুভাষবাবুর কফিন বন্দি দেহ যখন শববাহী গাড়িতে তোলা হল তখন শোকে আর্তনাদ করে উঠলেন তাঁর পরিবারের লোকজন। গাড়ির পিছনে পিছনে যতদূর পারলেন ছুটে গেলেন প্রৌঢ়া মা সাবিত্রীদেবী। সুভাষবাবুর বৌদি আরতিদেবী একটা কথা বারবার বলে যাচ্ছিলেন, “এভারেস্ট আর এভারেস্ট! এ ছাড়া আর কিছুই জানত না ছেলেটা! শেষে ওই পাহাড়ই ওকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল!”

অন্য বিষয়গুলি:

Deceased body Subhash Pal Mountaineer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE