Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Cyclone Amphan

হিসহিস করছিল যেন রাগী গোখরো, জমি আর চোখের নোনা জল একাকার

জ্বালানিই বা কোথায়? তাই দরকার রান্না করা খাবার পৌঁছনো। চলছে নৌকো জোগাড়ের ব্যবস্থা। কারণ ডাঙা নেই।

ঝড়ে লন্ডভন্ড সব কিছু। ভাঙা বেড়ার উপরেই আশ্রয়। ছবি: ঋত্বিক দাস

ঝড়ে লন্ডভন্ড সব কিছু। ভাঙা বেড়ার উপরেই আশ্রয়। ছবি: ঋত্বিক দাস

সিজার মণ্ডল
হিঙ্গলগঞ্জ শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২০ ২৩:২২
Share: Save:

উপড়ে পড়ে থাকা গাছ, কংক্রিটের দোমড়ানো মোচড়ানো বিদ্যুতের খুঁটি আর তারের জটলা কাটিয়ে অতি সন্তর্পণে পাকা রাস্তা ধরে এগোচ্ছে গাড়ি। সরু ফিতের মত রাস্তাটাই শুধু জানান দিচ্ছে ডাঙার অস্তিত্ব। কারণ দু’পাশে যত দূর চোখ যাচ্ছে সবটাই জল। কোনটা নদী, কোনটা জমি আলাদা করে ঠাওর করার জো নেই। তার মধ্যে দ্বীপের মত ভেসে রয়েছে আধডোবা জনপদ।

উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ পেরিয়ে হিঙ্গলগঞ্জ পৌঁছনোর পরেই সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি বছর তিরিশের শামিম মল্লিককে। বাড়ি হিঙ্গলগঞ্জেরই স্কুলমাঠ পাড়ায়। পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার শামিম দেখালেন, রাস্তার পাশে কোনও মতে যে কয়েকটা গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোর মাথার দিকে। গাছগুলোর মাথার ডালগুলো কেউ যেন প্রবল আক্রোশে ছিঁড়ে নিয়েছে। যেন বাস্তবের কোনও কিংকং দাপিয়ে বেড়িয়েছে গোটা এলাকায়। জল আর জমিনের সীমা মুছে যাওয়া একের পর এক গ্রাম দেখাতে দেখাতেই শামিম বলে যাচ্ছিলেন বুধবারের অভিজ্ঞতার কথা, ‘‘বিকেল পেরনোর পর থেকেই হাওয়ার গতি বাড়ছিল। আমরা বুঝতে পারি তুফানের মতি গতি। হাল ভাল নয় দেখে সবাই যে যার মতো পালিয়ে আশ্রয় নিলাম কাছের পাকা বাড়িতে।” তার পরের কথাগুলো বলে উঠলেন অনেকটা স্বগতোক্তির ঢঙেই, ‘‘খুব কাছে যদি কোনও খ্যাপা গোখরো থাকে, তাঁর শিসের যেমন আওয়াজ হয়, এ তুফানের হিসহিসানি তেমনই রক্ত জল করা।”

আয়লা যে বার আছড়ে পড়েছিল, সেই বার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। স্মৃতি টাটকা। কিন্তু শামিমের কথায়, বুধবারের সন্ধ্যার দেড় ঘণ্টা সেই আয়লাকেও ছাপিয়ে যায়। শামিমকে থামিয়ে দিল রাস্তার উপর কয়েকশো মানুষের জটলা। পুরুষ মহিলা শিশু সবাই আছেন সেই দলে। তাঁদের সামনে গাড়ি থামাতে হল। এঁরা সবাই শামিমের পরিচিত। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন এক যুবক। তাঁর চোখে মুখে উদ্বেগ, আতঙ্ক। বেশ রাগত স্বরে খারাপ ভাবেই বলে উঠলেন, ‘‘কী দেখতে এসেছেন? দেখবেন যদি রাস্তা ছেড়ে ভেতরে চলুন গ্রামের।” প্রায় টানতে টানতেই জলের স্রোত ঠেলে নিয়ে গেলেন আধডোবা গ্রামের দিকে। পরে জেনেছিলাম ওই যুবকের নাম প্রদীপ চক্রবর্তী। রাস্তার ডান পাশ থেকে প্রবল স্রোতে বয়ে আসা জল পায়ের পাতা ছাড়িয়ে হাঁটুর কাছাকাছি। মাটির দেওয়াল ধুয়ে গিয়েছে জলের তোড়ে। কোনও মতে টিকে রয়েছে বাঁশের ন্যাড়া কাঠামোটা। কারণ মাটির দেওয়ালের উপর টিন বা খড় যা ছিল তার অস্তিত্ব এখন আর নেই।

বাঁধের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটার মালিকরা। তাতেই বাঁধ ভেঙে জল ঢুকছে গ্রামে। অভিযোগ হিঙ্গলগঞ্জের একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের।

জলের স্রোতের দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রদীপ বলে ওঠেন, ‘‘আমপান যে দিন এল সেই দিন রাতেই ইছামতীর বাঁধ ভেঙেছে। প্রায় ২০০ মিটার জায়গা। তার পর দু’দিন কেটে গেল প্রায়। প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই বাঁধ সারানোর। ব্লক ডেভেলপমেন্ট বা বিডিও অফিসে বার বার বলার পর কয়েক গাছা বাঁশ নিয়ে বাঁধ মেরামত করতে এসেছে কয়েক জন। ওই বাঁশ দিয়ে এ রকম জলের তোড় রোখা যায়! ছেলেখেলা হচ্ছে?” প্রদীপের কথার রেশ ধরলেন আজিবর গায়েন। প্রৌঢ় আজিবর দূরের ইটভাটার চিমনির দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘‘আয়লাতেও আমাদের গ্রামে ইছামতীর বাঁধ ভাঙেনি। এ বার ভাঙল শুধু এই ভাটার জন্য। বাঁধের মাটি কেটে নেয় ভাটার মালিকরা, বাঁধের উপর গাছ কেটে দেয়। নেতা হোক বা প্রশাসন কেউ কিচ্ছু বলে না।” বাঁধ ভাঙা নিয়ে ক্ষোভ উগরোতে উগরোতে এ বার ত্রাণ নিয়েও সরব হলেন তাঁরা। সবারই এক অভিযোগ, ‘‘পঞ্চায়েত থেকেই কেউ আসেনি। ত্রাণ তো দূরের।” সবচেয়ে কাছের সাইক্লোন সেন্টার দু’ কিলোমিটার দূরে। মালপত্র নিয়ে অত দূর যেতে চাননি মানুষ। তাই আশ্রয় নিয়েছেন আশে পাশের পাকা বাড়িতে, নয়তো রাস্তার উপর।

কালিন্দী নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকছে। প্লাবিত হিঙ্গলগঞ্জের গ্রামের পর গ্রাম।

এ ভাবেই গত ৪৮ ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছেন রশিদ গাজি। এক হাঁটু জলের মধ্যে ডুবে থাকা মাটি আর দরমার দেওয়ালের কাঠামোর সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘এক বার আয়লা খেলো থাকার ঘরখানা। তার পর কখনও বুলবুল, কখনও ফণী। এ বার আমপান। লোকের বাড়িতে রাতে মাথা গুঁজছি। দিনে রাস্তায়। সামান্য বিড়ি বেঁধে আর লোকের ক্ষেতে মজুরি করে খাই। আমরা বাঁচব কী করে? এক হাতা খিচুড়িও তো পঞ্চায়েত এখনও দেয়নি।” তার পরেই হঠাৎ রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘‘সরকারকে কিছু করতে হবে না। শুধু মালপত্র দিক। বাঁধটা মেরামত আমরাই করে নেব। এ ভাবে থাকলে আরও ভাসবে।”

দেখুন ভিডিয়ো:

‘‘ভাটা শুরু হয়েছে। এ বার জল খানিক নামবে।’’ এত ক্ষণ শামিমের অস্তিত্বই ভুলে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে তাকালাম। জোয়ার-ভাটা তো নদী, খাল বিলে হয়। গ্রামের মধ্যে! শামিম স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করেছেন। বিএড করেছেন। শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার চেষ্টায়। প্রশ্ন শুনে খানিক দার্শনিক ঢঙেই উত্তর দিলেন, ‘‘দাদা, গোটা গ্রামটাই তো নদী। তাই এখন গ্রামেই জোয়ার ভাটি খেলছে। আর তা ছাড়া এই সুন্দরবনের বাদাবনের মানুষের তো জীবনটাই জোয়ার ভাটা।”

ঝড়ে বাড়িঘর লন্ডভন্ড। তার উপর জলে ভেসে গিয়েছে গোটা এলাকা। তাই দোকানেই আশ্রয়।

বাঁ দিকে ইছামতীকে পাশে রেখে সান্ডেলেরবিল গ্রাম পঞ্চায়েতের একের পর এক নোনা জলে ডোবা গ্রাম পেরিয়ে লেবুখালিতে পৌঁছলাম কালিন্দী নদীর ধারে। ওখানে তিন নদীর মোহনা। কালিন্দী, রায়মঙ্গল আর ডাঁসা। ঠিক ওপারে বাঁ দিক চেপে বাংলাদেশ। রায়মঙ্গলের ওপারে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত দুলদুলি, গোবিন্দকাঠি, যোগেশগঞ্জ, কালীতলা, সাহেবখালি। আর এক দিকে ভাণ্ডারখালি, শীতলিয়া, হাটগাছা, ভোলাখালি। বিশাল জেটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে ভেসেল। গাড়ি পারাপার করার। পারাপারের অপেক্ষায় একটা বড় জেনারেটর ভ্যান। কথা বলে জানা গেল, ওটা সরকারের জনস্বাস্থ্য দফতরের। যে কর্মী ওই ভ্যানের সঙ্গে রয়েছেন, তিনি বলেন, ‘‘এই জেনারেটর নিয়ে যাওয়া হবে যোগেশগঞ্জে। সেখানে সবটাই ডুবে গিয়েছে। খাওয়ার জলটুকুও নেই। তাই এই জেনারেটর দিয়ে সেখানে জনস্বাস্থ্য দফতর জল পরিশোধন করবে।” চারদিকে জল থই থই। টিউবওয়েল সব জলের তলায়। খাওয়ার জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, মোবাইলের পরিষেবাও বিচ্ছিন্ন। মালেকানঘুমটি, ছোট সাহেবখালি, রমাপুরে বৃহস্পতিবার সকালেই পৌঁছে গিয়েছিলেন সোপানের কয়েকজন যুবক। সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছেন খাবার। গবাদি পশুর জায়গা হয়েছে পাকা ছাউনির তলায়। কিন্তু অনেকেরই মত, চাল ডাল দিয়ে লাভ বিশেষ কিছু হচ্ছে না। কারণ মানুষ রান্না করবে কোথায়। জ্বালানিই বা কোথায়? তাই দরকার রান্না করা খাবার পৌঁছনো। চলছে নৌকো জোগাড়ের ব্যবস্থা। কারণ ডাঙা নেই। সবটাই জলে ডোবা। মানুষকে খাবার পৌঁছে দিতে গেলে দরকার নৌকা।

ভেসে গিয়েছে ফসলের জমি। বাসিন্দারা বলছেন, ঠিক হতে লাগবে অন্তত পাঁচ বছর।

সোপান একটি ছোট সমাজসেবী সংগঠন। তাঁদের একজন উজ্জল মণ্ডল। বানভাসি গ্রামের আধডোবা বিদ্যুতের খুঁটি দেখিয়ে বলেন, ‘‘জল না নামলে বিদ্যুৎ আসবে না। বিদ্যুৎ থাকলে তাও এই জল পাম্প করে বের করার চেষ্টা করা যায়। জমিতে নোনা জল বয়ে যাচ্ছে।” তাঁর কথায় মনে পড়ে গেল আয়লার সময়কার কথা। দয়াপুর, সাতজেলিয়ার পর পর গ্রামে জমিতে নোনা জল ঢুকে যাওয়ায় শুনেছিলাম হাহুতাশ। এ দিনও বৃদ্ধ শাহজাহান গাজি বলেন, ‘‘এই নোনা জল ঢুকল জমিতে। এ বার যে গাছ এখনও বেঁচে আছে তাও মরে যাবে। মাটিতে নুন না কমলে আর চাষ হবে না।” আয়লার পর অন্তত তিন বছর সময় লেগেছিল উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার ঝঞ্জা বিধ্বস্ত এলাকায় ফের চাষ হতে। একে এক ফসলি জমি। তাতে নুন জলে চাষ বন্ধ। তায়েব মোল্লা, বৃন্দাবন দাসরা জানেন, জল ক’দিন পর নেমে যাবে। বাড়ি ঘরও নিজের চেষ্টায় বা সরকারের দেওয়া টাকায় ফের তৈরি হবে। কিন্তু তার পর? পুকুরের মাছ ভেসে গিয়েছে। জমিতে নুন। এর পর তাঁরা খাবেন কী? ছবিটা একই রকম মিনাখাঁ, সন্দেশখালি থেকে শুরু করে বসিরহাট মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায়। সেখানে ইছামতীর বদলে বিদ্যাধরী।

হিঙ্গলগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী অর্চনা মৃধার বাড়িও এই এলাকায়। তিনি বলেন, ‘‘গোটা ব্লকে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত ১৬টি সাইক্লোন সেন্টার, ৬টি ফ্লাড রিলিফ সেন্টার এবং ৭০টি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।” তিনিও স্বীকার করেন, ত্রাণ বা খাবার পৌঁছতে কিছু সমস্যা হয়েছে। তবে তাঁর দাবি, শুক্রবার থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে খাবার পৌঁছনোর প্রক্রিয়া। তাঁর হিসাবে ব্লকে প্রায় ৭০০ হেক্টর চাষের জমি নোনা জলে ভেসে গিয়েছে। সেই নোনাজলে ডোবা ঘরের দাওয়াতে বসেই ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন বাঁকড়া গ্রামের মুমতাজ বিবি। সমস্ত জিনিস ভেসে গিয়েছে। তাঁর চোখের নোনা জল মিশছে জমিনের নোনা পানিতে। সে দিকে তাকিয়ে এক বৃদ্ধ অস্ফুটে বলেন, ‘‘এ বারের ইদের নমাজ এই লোনা পানিতেই সারতে হবে।”

ছবি ও ভিডিয়ো: ঋত্বিক দাস

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Cyclone Amphan Hingalganj Hasnabad Sundarbans
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy