এই ছাউনিতেই মিলেছিল নাবালিকার দেহ। শনিবার ঘটনাস্থলে তদন্তে সিআইডি। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
খটকা ১: খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির দেওয়াল ডিঙিয়ে কেউ বা কারা বাড়িতে ঢুকল। দাওয়াই তিন জনের মাঝে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মেয়েটিকে অনায়াসে তুলে নিয়ে কাঠের দরজার খিল খুলে চলে গেল তারা। বাড়ির কেউ কিছু টের পেলেন না কেন?
খটকা ২: মাঝরাতে নিখোঁজের খবর চাউর হওয়ার ৪০ মিনিটের মধ্যে মেয়েটির নিথর দেহ দেখতে পেয়েছিলেন গ্রামের দুই ব্যক্তি। তাঁরা মাঠের ওই খড়ের ছাউনির ভিতরেই খুঁজতে গিয়েছিলেন কেন?
তারাপীঠে ধর্ষণ করে নাবালিকা খুনের ঘটনায় রকমই নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সিআইডি। শুক্রবারই ওই মামলার তদন্তভার নিয়েছে তারা। রাতে তারাপীঠের ওই গ্রামে গিয়ে সিআইডি-র চার সদস্যের একটি টিম নির্যাতিতার গ্রামে যায়। সেখানে আধিকারিকেরা নির্যাতিতার পরিবারের লোকেদের সঙ্গেও কথা বলেন। পরে শনিবার সকালে গ্রামে গিয়ে আরও একদফা জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। দুপুরে আবার সিআইডি-র এসপি চিরন্তন নাগ-সহ আরও এক গোয়েন্দা আধিকারিক গ্রামে যান। পরিবারের লোক জনের সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও পোঁছে যান ঘটনাস্থলেও। দফায় দফায় নির্যাতিতার বাবা, মা, ঠাকুমা, এবং কিছু আত্মীয় ও পড়শিকে জেরা করেন সিআইডি-র সদস্যেরা। মূলত ওই বাড়িতে কার কার যাতায়াত ছিল, মেয়েটি মোবাইল ব্যবহার করত কিনা, ঘটনায় কাউকে সন্দেহ হয় কিনা— এমন নানা ধরনের প্রশ্ন করেন সিআইডি আধিকারিকেরা। জেরা থেকে বাদ যায়নি নির্যাতিতার সপ্তম শ্রেণির দাদা এবং নবম শ্রেণিতে পড়া মাসতুতো দাদাও। ফিরে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে চিরন্তনবাবু বলেন, ‘‘ঘটনার তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এখনই কিছু বলা যাবে না।”
এ দিকে, শুক্রবারের গভীর রাতের ওই ঘটনায় বিকালেই পুলিশ গ্রামের বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকেছিল। তাঁদের মধ্যে এক যুবক ও এক প্রৌঢ়কে এ দিন বিকাল পর্যন্ত আটক করে রাখা হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, আটক দুই ব্যক্তিই বালিকাটির মৃতদেহের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ওই প্রৌঢ় নির্যাতিতার আত্মীয়ও বটে। জেলা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘গ্রামের অধিকাংশ লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বালিকাটির সন্ধানে খোঁজাখুঁজি করছিলেন। তখন ওই দু’জনই সবার প্রথমেই গ্রামের বাইরে মাঠের দিকে গিয়ে মৃতদেহটি দেখতে পেয়েছিলেন। আটক দু’জনের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে গ্রামবাসীর একাংশের কাছ থেকে খারাপ রিপোর্টও এসেছে। জিজ্ঞাসাবাদে সন্তোষজনক উত্তর মিললে ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে।’’
অন্য দিকে, যে খড়ের ছাউনি থেকে তাঁদের মেয়ের দেহ মিলেছে, সেটি গ্রামেরই এক চাষির বানানো। গরমের সময়ে ওই খড়ের পাশে তাঁর একটি সাব-মার্সিবল পাম্প চলে। তারই প্রয়োজনে বানানো হয়েছিল ওই ছাউনি। বর্তমানে পাম্পসেট সরিয়ে নেওয়ায় পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল ওই ছাউনি। তবে, বালিকাটির উপরে নির্যাতনের ঘটনাটি ওই ছাউনিতে ঘটেনি বলেই প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান। জেলা পুলিশের ওই কর্তার মতে, ‘‘ছাউনিটি অত্যন্ত ছোট। সেখানে ঘটনাটি ঘটে বলেই মনে হচ্ছে। বাড়ি আর ছাউনির মাঝে কোথাও একটা উপরে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে ওই মেয়েটিকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়ে থাকতে পারে।’’ তার পরেই লোকের নজর এড়াতে মেয়েটির নিথর ফেলে দেওয়া হয়েছে ওই পরিত্যক্ত ছাউনিতে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, মেয়েটির বাবা মজুর জোগাড় করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করে রোজগার করেন। তার সূত্রে তাঁকে মাঝে মধ্যেই বাইরে থাকতে হয়। ঘটনার ঠিক আগের রাতেই তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পারিবারিক কারণে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন। যে দিন ফিরলেন, সে দিন রাতেই অঘটনটি ঘটে গেল। অথচ দিন পনোরে আগেই গরমের ছুটিতে বাড়ি ফিরেছিল মেয়ে। সেই মেয়েরই এমন নৃশংস হত্যায় বিধ্বস্ত বাবা-মা। তাঁরা এ দিন বলেন, ‘‘সিআইডি তদন্ত শুরু করায় আমরা খুশি। কিন্তু, আমার মেয়ের খুনিদের জলদি খুঁজে বের করতে হবে ওদের।’’
পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে এ দিনই গ্রামে গিয়েছিলেন বিভিন্ন দলের নেতা-মন্ত্রীরা। বিকেলে গ্রামে পৌঁছেছিলেন রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়ে এই ঘটনাটিকে দেখছেন। তার জন্য এই ঘটনায় তিনি সিআইডি তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করবে সিআইডি।’’ বিকেলেই ওই গ্রামে পৌঁছে যায় বিজেপি-র একটি প্রতিনিধিদলও। দলের জেলা সহ-সভাপতি শুভাশিস চৌধুরী বলেন, ‘‘আগামী বৃহস্পতিবার রাজ্য নেতৃত্বের এই গ্রামে আসার কথা। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও পুলিশ বা সিআইডি এই ধরনের নারকীয় ঘটনার কিনারা করতে পারল না। এটা অত্যন্ত লজ্জার।’’ সন্ধ্যায় ওই গ্রামে যান এলাকার কংগ্রেস বিধায়ক মিল্টন রশিদও। তিনি মেয়ের খুনের বিচার পেতে পাশে থাকার আশ্বাস দেন পরিবারকে। মিল্টন বলেন, ‘‘অত্যন্ত নৃশংস ঘটনা। খুনিদের দ্রুত খুঁজে বের করুক সিআইডি। পরিবারকে ন্যায়বিচার দিতে যা যা দরকার, তা করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy