শতাব্দী বীরভূমের দায়িত্ব নেবেন? ফাইল চিত্র।
আপাতত সিবিআই ১০ দিনের জন্য হেফাজতে পেয়েছে তাঁকে। তদন্তের যা গতিপ্রকৃতি, তাতে সিবিআই হেফাজতের মেয়াদ আরও বাড়তে পারে অনুব্রত মণ্ডলের। সেই প্রেক্ষিতেই তৃণমূলে শুরু হয়েছে জল্পনা— অনুব্রতকে কি বীরভূমের জেলা সভাপতি পদে রাখবেন তৃণমূল নেতৃত্ব? এই প্রশ্ন আরও বেশি করে উঠছে সম্প্রতি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে তাঁকে মন্ত্রিত্ব এবং দলের সমস্ত পদ থেকে অপসারণ করায়।
তৃণমূলে তো বটেই। রাজ্য রাজনীতিতেই বীরভূম এবং অনুব্রত সমার্থক। সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা এখন সিবিআইয়ের হেফাজতে। তাঁর অনুপস্থিতিতে জেলার সাংগঠনিক কাজকর্ম চালাবেন কে? কাউকে কি অস্থায়ী দায়িত্ব দেওয়া হবে, নাকি একেবারে নতুন মুখ এনে সংগঠনকে ঢেলে সাজা হবে? সিবিআই বৃহস্পতিবার বিকেলে অনুব্রতকে গ্রেফতারের পর থেকেই এই প্রশ্ন নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। প্রথম প্রশ্ন, অনুব্রতকে কি জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে? দ্বিতীয়ত, যদি দেওয়া হয়, তা হলে তাঁর জায়গায় কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে?
অনুব্রতের দলীয় পদ (তিনি একটি সরকারি পদেও রয়েছেন) নিয়ে প্রশ্ন করায় তৃণমূলের নেতারা সেটি দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু জল্পনা তাতে থেমে নেই। সেই জল্পনার মধ্যেই উঠছে সাংসদ শতাব্দী রায়ের নাম।
এমনিতে অনুব্রত-শতাব্দী সম্পর্ক বরাবরই ‘মধুর’। একটা সময়ে অনুব্রতের দাপটে ‘বীতশ্রদ্ধ’ হয়ে শতাব্দী বীরভূমের বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মসূচিতে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁদের অসমীকরণের কথা এতটাই প্রচারিত যে, একটি কর্মসূচিতে পাশাপাশি আসনে বসে দু’জনের পরস্পরের দিকে ঝুঁকে কথা বলার ছবি নিয়ে বিবিধ ‘মিম’ তৈরি হয়েছিল। সেখানে শতাব্দীকে ‘কেষ্টর রাধা’ বলতেও ছাড়েননি লোকজন। শতাব্দী দলের অন্দরে অনুব্রতের সম্পর্কে বারংবার তাঁর উষ্মার কথা জানিয়েছেন। ধৈর্য হারিয়ে কখনও সখনও প্রকাশ্যেও মন্তব্য করে ফেলেছেন। কিন্তু দলের শীর্ষনেতৃত্ব শতাব্দীর বিরক্তিকে খুব একটা আমল দেননি।
সেই পরিস্থিতিতেই অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, বীরভূমে দলের ‘ভাবমূর্তি’ বদলাতে কি ধৃত অনুব্রতকে সরিয়ে শতাব্দীকে জেলা সভাপতি করা হতে পারে?
শতাব্দী নিজে অনুব্রতের গ্রেফতারি নিয়ে কোথাও কোনও মন্তব্য করেননি। তাঁর সঙ্গে ফোনেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠেরা জানিয়েছেন, এই সাংসদ আপাতত দিল্লিতে রয়েছেন। এবং তিনি অনুব্রতের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চান না। টালিগঞ্জের সঙ্গে পেশা সূত্রে জড়িত এবং শতাব্দীর এক হিতৈষীর কথায়, ‘‘এত দিন ও অনুব্রতের বিরুদ্ধে বলেছে ঠিকই। কিন্তু এখন ও (অনুব্রত) বিপদে পড়েছে। এখন শতাব্দী মানসিক ভাবে ওর সঙ্গে আছে। এখন আক্রমণ করা বা মুখ খোলাটা ঠিক হবে না বলেই শতাব্দীর অভিমত। এখন ওর চুপ করে থাকাই উচিত।’’
বস্তুত, শতাব্দীর হিতৈষীরা চান না, দল তাঁকে বীরভূমের সভাপতির দায়িত্ব দিলে শতাব্দী তা নিন। কারণ, এত দিন যে ‘স্টাইলে’ বীরভূম জেলা চালানো হয়েছে, তা একেবারে মুছে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে কাজ শুরু করা এই অভিনেত্রী-সাংসদের পক্ষে সম্ভব নয়। বীরভূমেরই এক নেতার কথায়, ‘‘কেষ্ট’দা যে সিস্টেমে এখানে দল চালিয়েছেন, তাতে নতুন করে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী দিয়ে কেউ দল চালাতে পারবেন না। শতাব্দী রায়কে ব্যবহার করে দলের ভাবমূর্তি মেরামত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু জেলা সভাপতি করে নয়।’’
বীরভূমের জেলা নেতাদের অধিকাংশই মনে করেন, শতাব্দীকে জেলা সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা নেবেন না। তাঁদের বক্তব্য, সাংসদ হিসেবে শতাব্দী রায় প্রচুর কাজ করেছেন। কিন্তু জেলার সংগঠনে যে ভাবে অনুব্রত তাঁর প্রভাব বিস্তার করে, তাঁর বিভিন্ন লোককে বসিয়ে রেখেছেন, তাতে শতাব্দীর পক্ষে সাংগঠনিক কাজ চালানো মুশকিল। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা বলছেন, অনুব্রতের দেহরক্ষী সায়গল যে তাঁর হয়ে ‘কাজ’ করতেন, সেটা জেলার কারও অজানা ছিল না। এক জেলা নেতার কথায়, ‘‘চায়ের দোকানে যে গ্লাস ধোয়, সে পর্যন্ত জানে, কে কত টাকা নেয়! কে কার হয়ে টাকা তোলে! কাউকে তোয়াক্কা করত না কেউ। কোনও আড়ালও রাখা হত না। এতটাই বেপরোয়া ছিল অনুব্রতের লোকজন। পরিস্থিতি যে জায়গায় গিয়েছে, তা শতাব্দী রায়কে সভাপতি করলে এখনও বদলে যাবে না।’’
তবে পাশাপাশিই তাঁরা বলছেন, দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে সাংসদকে ব্যবহার না-করলে সেটাও ঠিক হবে না। কিন্তু সেটা জেলা সভাপতি পদে রেখে নয়। তাঁকে অন্য ভাবে ব্যবহার করে। এবং তাঁদের অনুমান, শতাব্দীর তাতে কোনও আপত্তি থাকবে না।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, অনুব্রত যে ‘ঐতিহ্য এবং উদাহরণ’ ছেড়ে সিবিআইয়ের হেফাজতে গেলেন, তা দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু পালাবদল হলেও তা একটা ‘পরিবর্তন’ও বটে। চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি প্রথম বার সিবিআইয়ের মুখোমুখি হয়ে বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়িতে ফেরার পর অনুব্রতে গাড়ি ঘিরে ‘কেষ্টদা জিন্দাবাদ’ স্লোগান উঠেছিল। মাস তিনেকের ব্যবধানে বৃহস্পতিবার গরুপাচার মামলায় ধৃত বীরভূমের ‘বাহুবলী’ নেতাকে সিবিআই গাড়িতে তোলার পর একই রাস্তার দু’পাশে জড়ো হওয়া জনতার মুখে শোনা গেল ‘গরুচোর, গরুচোর’!
কয়েক দিন আগেও বীরভূমে এই ছবি কল্পনা করা যেত না। সে কারণেই জল্পনা শুরু হয়েছে— প্রায় তিন দশক বীরভূমে একচ্ছত্র ‘অনুব্রত-যুগ’ কি শেষ?
মাছ ব্যবসায়ী অনুব্রতের রাজনীতিতে হাতেখড়ি কংগ্রেস দিয়ে। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠন হলে অনুব্রত যোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে। প্রথম কয়েক মাস জেলার যুব সভাপতি ছিলেন। তার পর থেকে বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি এক জনই— অনুব্রত মণ্ডল।
২০০৯ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বীরভূমে বড় সাফল্য পায় বীরভূম। বাড়ে অনুব্রতের দাপট। বীরভূমের রাজনীতিতে অনুব্রতের পাশাপাশি বিকাশ রায়চৌধুরী, চন্দ্রনাথ সিংহের প্রভাবও ভাল। তবে জেলায় ধারাবাহিক ভোট-সাফল্য এবং সংগঠনিক ক্ষমতার জন্য মমতার ‘আস্থাভাজন’ হয়ে ওঠেন কেষ্ট। সেই আস্থা বহু বিতর্কের পরও টাল খায়নি। প্রকাশ্যেই বহু বার অনুব্রতের ‘রক্ষক’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন মমতা। বার বার বলেছেন, ‘‘কেষ্ট খুব ভাল ছেলে। প্রচুর কাজ করে।’’
কিন্তু বৃহস্পতিবার সেই অনুব্রতের গ্রেফতারির পর তৃণমূল সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছে, দুর্নীতির সঙ্গে কোনও আপস নয়। সেই সূত্রেই জল্পনা তৈরি হয়েছে ‘নতুন’ জেলা সভাপতি নিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy