প্রতীকী ছবি
হুগলির সিমলাগড়ের ফকির হেমব্রমের সঙ্গে কোথায় মিল মালবাজারের শনিচর ওরাওঁয়ের?
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে দুই পরিবারেই আসে শিশুর খাবার। তার পরে বাঁটোয়ারা হয়। ফকির তাঁর তিন বছরের ছোট ছেলের ভাগ থেকে চাল, ডাল, আলু ভাগ করে দেন ছ’বছরের বড় ছেলেকে। বলেন, ‘‘ওর মুখে কিছু না দিয়ে শুধু ছোটটাকে দেওয়া যায়!’’
মালবাজারের রাজা চা বাগানের শ্রমিক শনিচরের পুরো পরিবার ভাগ বসায় তাঁর আট বছরের অপুষ্ট ছেলের খাদ্যে। শনিচর বলেন, ‘‘সেন্টার (অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র) থেকে যা দেয়, সবটাই ছেলেটাকে দেওয়া উচিত। জানি। কিন্তু করোনায় কাজ নেই, আমরাই বা কত আধপেটা খেয়ে থাকব!’’
খিদের পেটে এক পংক্তিতে এসে গিয়েছে দুই পরিবার। একে করোনা আবহে কাজের বাজারে টান। তার উপরে স্কুলের মিড-ডে মিল থেকে অঙ্গনওয়াড়ির ভাণ্ডারে পদ এসে ঠেকেছে মূলত চাল, ডাল, আলুতে। তা-ও আবার স্কুল বা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র খুলে, সেখানে রান্না করে পাত পেড়ে বসিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা নয়, প্যাকেট করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি বাড়ি। তাতেই ভাগ বসছে অপুষ্ট শিশুর খাদ্যে।
করোনা আবহে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি বন্ধ থাকায় অপুষ্ট শিশুর হিসেব রাখাই হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সেই সংখ্যা কোথায় পৌঁছবে, কেউ জানে না। তার উপরে তালিকাভুক্ত অপুষ্ট শিশুদের পাতেও যদি ঠিক মতো খাবার না পড়ে, বিপদ আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের কর্মীরা।
কেন এই অপুষ্টি, তার কারণ খুঁজে সেই মতো খাদ্য থেকে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার চল দীর্ঘদিনের। জেলা প্রশাসনের মতে, অপুষ্টির মূলে রয়েছে নাবালিকা বিয়ে। ১৮ বছরের থেকে কম বয়সে যার বিয়ে হচ্ছে এবং যে ১৮ বছরে বয়সে পৌঁছনোর মধ্যেই এক বা একাধিক বার গর্ভধারণ করছে, তার নিজেরই পুষ্টির ঘাটতি থাকে। ফলে গর্ভের সন্তানের পুষ্টি হবে কী করে? প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের কর্মীরা জানাচ্ছেন, গর্ভবতী থাকার সময়ে সেই নাবালিকা মায়েদের খাওয়াদাওয়া এবং অন্য নিয়ম মানার ক্ষেত্রেও গাফিলতি থাকে। তাতে সমস্যা আরও বাড়ে।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাতৃ মা বিঘাগের বিভাগীয় প্রধান ভাস্করানন্দ শীল বলেন, ‘‘(বহু ক্ষেত্রেই) গর্ভবতী মায়েরা উপযুক্ত পরামর্শ না পাওয়ায় পুষ্টিকর খাবার কম খাচ্ছেন। বিশ্রাম কম পাচ্ছেন। ফলে গর্ভের শিশুর পুষ্টির ঘাটতি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতিতে মায়ের যেমন অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হচ্ছে, তেমনই কম ওজনের শিশু জন্ম নিচ্ছে।’’
করোনা আবহে স্কুল বন্ধ। ফলে নাবালিকা বিয়ে বেড়েছে বলেই মনে করছে প্রশাসনের একটা বড় অংশ। সম্প্রতি দক্ষিণ দিনাজপুরের তপনে একটি চোদ্দো বছরের মেয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে জেলার শিক্ষাব্রতীরা দেখেন, তিন মাস আগে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন সে দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ঠিক একই ভাবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বন্ধ থাকায় অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতিদের জরুরি পরামর্শ দেওয়াও আপাতত স্থগিত। বন্ধ হয়ে রয়েছে এদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার কাজও।
একই ভাবে অপুষ্ট শিশুদের পাত পেড়ে বসিয়ে খাওয়ানোও বন্ধ এখন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু চাল, ডাল, আলু পৌঁছে দিয়ে আসার কাজ চলছে। জুন থেকে কয়েকটি জেলায় শুরু হয়েছে অপুষ্ট শিশুদের সমীক্ষা। তা এখনও প্রাথমিকস্তরে। তাই পরিস্থিতি কতটা সঙ্গীন, তা সংখ্যা দিয়ে বোঝার সময় আসেনি। তবে সামান্য কিছু তথ্য থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছে, অবস্থা একেবারেই ভাল নয়।
বিভিন্ন জেলার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা বলছেন, এর আর এক কারণ, তালিকা থেকে ডিম ও সয়াবিন বাদ হয়ে যাওয়া। পুষ্টির মূল হিসাবে ধরা হত এই দু’টিকে। শুধু চাল, ডাল, আলুতে ডিম-সয়াবিনের ঘাটতি পোষানো কঠিন। দ্বিতীয়ত, সেই খাবারেও ভাগ বসছে। অনেক বাড়ির মূল রোজগেরে কর্মহীন। রেশন থেকে চাল, ডাল পেলেও সব সময় সেটা পর্যাপ্ত হয় না বলেই তাঁদের অনেকের দাবি। খিদে মেটাতে তাই ভাগ হয় অপুষ্ট শিশুর খাদ্য। ফলে অপুষ্ট বাচ্চাটি আরও অপুষ্ট হয়। পশ্চিম বর্ধমানের অন্ডালের শ্রীরামপুর ও রঘুনাথচকের দুই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের দুই কর্মী মিঠু মিত্র ও সুনন্দা মাজিদের কথায়, ‘‘আমরা মাঝেমধ্যে কেন্দ্রে এসে খাবার বিলি করি ঠিকই, কিন্তু মনে হয়, কোনও ভাবে ওই শিশুদের খাওয়াদাওয়া ঠিক হচ্ছে না।’’
এই শুকনো খাবারও কিন্তু নিয়মিত ভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছয় না। কারণ, ভোটের আগে থেকে দুয়ারে সরকারের মতো সরকারি কর্মসূচিতে যেতে হয় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। যেতে হয় ভোটের কাজেও। ফলে ধাক্কা খায় গোটা কর্মসূচি। বস্তুত, অতিমারির মতো বিপদের সময়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি কী ভাবে চালানো হবে, তার তেমন বিকল্প ভাবনা প্রশাসনের মাথায় ছিল না। দেড় বছর ধরে কেন্দ্রগুলি বন্ধ। তার মধ্যেও বিকল্প ভাবনা তৈরি হয়নি। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট প্রোগ্রাম অফিসার (অঙ্গনওয়াড়ি) প্রান্তিক ঘোষ সে কথা মেনে নিয়েই বলেন, ‘‘সেন্টার না খুললে বিকল্প কোনও কিছুই সম্ভব নয়।’’ (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy