Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Lockdown

কাজ নেই=পয়সা নেই, আকালের ভয়াল সঙ্কেতে দিলীপ মাঝির বৃত্তান্ত

এক দিকে মারণ কোভিডের থাবায় প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। আতঙ্ক চারদিকে। আর তার মধ্যেই বিশ্বব্যাপী মন্দা। এই দুইয়ের মধ্যেই হারিয়ে যায় দিলীপ মাঝির মতো লাখো লাখো মানুষের জীবনের গল্প। সেই বৃত্তান্তই তুলে ধরা হচ্ছে আপনাদের সামনে। আজ প্রথম দফা।এক দিকে মারণ কোভিডের থাবায় প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। আতঙ্ক চারদিকে। আর তার মধ্যেই বিশ্বব্যাপী মন্দা। এই দুইয়ের মধ্যেই হারিয়ে যায় দিলীপ মাঝির মতো লাখো লাখো মানুষের জীবনের গল্প। সেই বৃত্তান্তই তুলে ধরা হচ্ছে আপনাদের সামনে। আজ প্রথম দফা।

শুধু দিলীপ মাঝি নন, তাঁর মতো অসংখ্য পরিবারেও এখন এই অবস্থা। হুগলির গঙ্গাধরপুর গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

শুধু দিলীপ মাঝি নন, তাঁর মতো অসংখ্য পরিবারেও এখন এই অবস্থা। হুগলির গঙ্গাধরপুর গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
গঙ্গাধরপুর (হুগলি) শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৪৫
Share: Save:

একপাশে আলগা ইটের দেওয়াল। তার উপর বাঁশ আর ত্রিপল ফেলে তৈরি করা হয়েছে ছাউনি। আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে এক কামরার ঘরটা। বোঝা যায়, ইটের মালিক দেওয়াল গাঁথার জন্যই এগুলো কোনও এক সময়ে কিনে রেখেছিলেন। কিন্তু তার পর আর দেওয়াল তোলা হয়ে ওঠেনি।

ছাউনির তলায় এবড়ো-খেবড়ো মাটির মেঝে। সেখানে উবু হয়ে বসা এক মাঝবয়সি মানুষ। চোখ দু’টো সামনের উনোনে চাপানো তিজেল হাঁড়ির দিকে। মাটিতে খোঁড়া তিন দিকে ইট দিয়ে ঘেরা উনোনের মধ্যে গোঁজা একরাশ কাঠকুটো। নীলচে ধোঁয়া হাঁড়ির গা বেয়ে উঠছে। এক মহিলা মাথা নিচু করে ক্রমাগত ফুঁ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন আগুনটা জোরালো করতে। বছর ৩৮-এর মহিলার পরনে হলদে জমির উপর লাল ফুল তোলা ছাপা শাড়ি। কিন্তু বিবর্ণ হলুদ রঙের মধ্যে লাল ফুলগুলোও ততোধিক বিবর্ণ।

উবু হয়ে বসে থাকা মানুষটার পরনে নীল চেককাটা লুঙ্গি। সেটাও বেশ কিছু দিন যে সাবানের মুখ দেখেনি, তা বাইরের চেহারা থেকেই স্পষ্ট। মানুষটার কাছে গেলে শোনা গেল, বিড় বিড় করে আপনমনেই বলছেন— ‘‘পাঁচ পাঁচটা পেট চালানো কি সহজ কথা! এ বেলাটা কোনও মতে চলে গেল। এ বার কী হবে?।”

আরও পড়ুন: লকডাউন কোথায়, কতটা ছাড়, কাল জানাবেন প্রধানমন্ত্রী

মধ্য পঁয়তাল্লিশের দিলীপ মাঝিকে এ রকম হা-হুতাশ করতে কস্মিনকালেও শোনেননি তাঁর পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব বা পড়শিরা। বেঁটেখাটো শক্তপোক্ত চেহারার দিলীপকে হুগলি চণ্ডীতলার গঙ্গাধরপুর গ্রামে সবাই এক ডাকে চেনেন ‘সব কাজের কাজি’ হিসাবে। কখনও মোটর ভ্যান চালাচ্ছেন, আবার পরের দিনই হয়তো পাশের পাড়ায় রাস্তার কাজ করছেন। নয়তো মাঠে চাষের কাজ করছেন। দিলীপের এক কথা— ‘‘কাজ করলে পয়সার অভাব হয় না।”

কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে গোটাটাই ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। দিলীপের গত ৩০ বছরের যাবতীয় রুটিন ভেঙে গিয়েছে। অন্য সময় হলে রাত থাকতেই বিছানা ছাড়েন তিনি। ভোরবেলা মোটর ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সব্জি হোক বা অন্য কোনও মাল নিয়ে বারুইপাড়া স্টেশন। সেখান থেকে যেমন ভাড়া পাওয়া যায়। দুপুর পর্যন্ত ভাড়া খেটে বাড়ি এসে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘণ্টা দুয়েক জিরিয়ে নিয়েই ফের বিকেল থেকে শুরু। দিলীপের কথায়, ‘‘ক’দিন আগে পর্যন্ত ভাল রোজগার হয়েছে। মাঠ থেকে আলু হিমঘরে পৌঁছে দেওয়া। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত। নাওয়া-খাওয়ার সময় মেলেনি। বদলে রোজগারও ভাল হয়েছে। কিন্তু লকডাউন ইস্তক সব বন্ধ।”

শুকিয়ে রাখা বাঁধাকপিই পেট ভরাতে ভরসা অনেক পরিবারের। —নিজস্ব চিত্র।

বন্ধ সব কিছুই। অন্য সময় হলে দিলীপের বাড়ি থাকা মানেই সকাল থেকে বেশ কয়েক বার ভাল করে দুধ দিয়ে ফোটানো কড়া চা। নিজেই বলেন, ‘‘আমি খেতে ভালবাসি। এত খাটাখাটনি তো খাওয়ার জন্যই।” তা দিলীপের বাড়ি থাকা মানেই তরিবত করে খাওয়াদাওয়া। সকালের জলখাবারটাও একটু আয়েশ করে, মুড়ির সঙ্গে জিলিপি বা বোঁদে দিয়ে। তার পর বেশ কায়দা করে একটা সিগারেট ধরিয়ে পাড়ায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেলা পর্যন্ত আড্ডা।

সেই দিলীপ বাড়িতেই রয়েছেন। কিন্তু লকডাউন বদলে দিয়েছে তাঁর সব রুটিন। আনমনেই বলে ওঠেন, ‘‘এখন তো রোজই বাড়িতে। কোথাও যাওয়ার নেই।” বাড়িতে থাকলেও, বদলে গিয়েছে ছুটির মেজাজ। স্ত্রী সরস্বতীর কাছে বার বার চায়ের আবদার নেই। জলখাবার নিয়েও মাথাব্যথা নেই। আপনমনে ঘুরে ফিরে দিলীপের একটাই প্রশ্ন— এ ভাবে আর ক’দিন?

আরও পড়ুন: তেলের উৎপাদন কমছে ১০ শতাংশ, লকডাউনে তেলের দাম ধরে রাখতে ঐতিহাসিক চুক্তি

চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ রোদে বাইরেটা জ্বলছে। সে দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় দিলীপ বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতেরও কাজ নেই। বৃষ্টি নেই যে মাঠে কোনও কাজ হবে।” এমনিতে, দিলীপ মোটর ভ্যানের তেল-মবিল, টায়ার সারাই সব খরচ বাদ দিয়ে গড়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা বাড়ি নিয়ে ফেরেন। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে কামাই নেই এক টাকাও, অথচ খরচা রয়ে গিয়েছে আগের মতোই।
হাতের আধপোড়া বিড়িটা উঠোনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে দিলীপ বলেন, ‘‘আগের সপ্তাহে কার্ড পিছু ২ কিলো করে চাল আর ১ কিলো করে আটা দিয়েছে রেশন থেকে। তাই দিয়ে কোনও মতে চলছে। আলু হিমঘরে তোলার সময় কিছু বাড়তি টাকা পেয়েছিলাম। সেই টাকা থেকে মোটর ভ্যানের কিস্তি মিটিয়ে, মোবাইলে টাকা ভরে যা হাতে ছিল তা দিয়ে আগের সপ্তাহ চলেছে। রেশন থেকে যা দিয়েছিল তা এ বেলা শেষ। এ বার কী করব জানি না।”

দিলীপের কথা শুনে পাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন স্ত্রী সরস্বতী— ‘‘হাতে টাকা থাকলে তো রাখতে জানে না। তখন মাংস চাই, কাটা পোনা চাই। সকালে মুড়ি খেতে ভাল লাগে না। দোকানে পরোটা আলুর দম খাবে।” মুখ ফিরিয়ে সরস্বতী ফের বলে ওঠেন, ‘‘আমরা গ্রামের মানুষ। দু’বেলা জলখাবারেই লাগে প্রায় ৭০০ গ্রাম মুড়ি। আমাদের তো জল ছাড়া সবই কিনে খেতে হয়। এখন আর মুড়িও কেনার পয়সা নেই। পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা অল্প চাল ছিল। তাই ভেজে এক মুঠো করে সকালের জলখাবার হচ্ছে। প্রথম ক’দিন বাজার থেকে সব্জি কেনা হয়েছিল। তার পর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে আলু জোগাড় হয়েছিল। গত ক’দিন ভাতের সঙ্গে ভরসা সজনে গাছের পাতা।”

কাল কী রান্না হবে জানে না দিলীপের পরিবার। —নিজস্ব চিত্র।

স্ত্রী সরস্বতী ছাড়াও, দিলীপের সংসারে রয়েছেন বছর ২২-র ছেলে শুভদীপ, পুত্রবধূ এবং সাড়ে তিন বছরের নাতনি ঈশা। রোজগেরে বলতে দিলীপ একাই। সরস্বতীর হিসাবে পাঁচজনের সংসারে দু’বেলা মিলিয়ে লাগে কম করেও পৌনে দু’কিলো চাল। উনোনে চাপানো হাঁড়ির ফুটন্ত জলে চাল ফেলতে ফেলতে সরস্বতী বলেন, ‘‘রেশনে দেওয়া চালের শ’পাঁচেক ছিল। জানি না এই ভাত কার মুখে তুলে দেব।” উনোন থেকে কিছু দূরে রয়েছে গ্যাস আভেন। সে দিকে তাকাতেই সরস্বতী বলেন, ‘‘গ্যাস নেব টাকা কোথায়? তাই মাঠ থেকে কাঠ কুটো কুড়িয়েই কাজ চালাচ্ছি।”

সরস্বতীর আক্ষেপ, যা রোজগার করেন তার প্রায় সবটা খেয়েই খরচ করে ফেলেন দিলীপ। মাটি থেকে উঠে এ বার বারান্দায় পাতা তক্তপোষের উপর বসলেন দিলীপ। তোষকের তলায় কোনও এক গোপন খাঁজ থেকে একটা কৌটো বের করে সযত্নে একটা বিড়ি বের করে মুখ খুললেন, ‘‘দিনভর কাজ করা তো খাওয়ার জন্যই। রাত থাকতে ভ্যান নিয়ে বেরনোর সময় তো এক কাপ লাল চা আর দুটো মেরি বিস্কুট ছাড়া কিছু জোটে না। তাই প্রথম ট্রিপ শেষ হলেই স্টেশনের ধারের দোকানে একটু পরোটা আলুরদম খেয়ে নিই। তার পর তো সেই বাড়ি ফিরে দুপুরে খাওয়া। সব দিনই কি মাছও জোটাতে পারি। ওই ডাল ভাত তরকারি।” সদ্য ধরানো বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে দিলীপ আনমনেই বলে ওঠেন, ‘‘চাল-ডালের খরচ বাদ দিলেও, তেল নুন চিনি মশলার খরচ আছে। জামা কাপড়ের খরচ আছে। লোকলৌকিকতা আছে। তার পর আর ওই সাড়ে ৩০০-চারশো টাকা থেকে বাঁচে কী?”

নাতনিকে পাশের পাড়ার একটা স্কুলে ভর্তি করার জন্য চোদ্দশো টাকা আলাদা করে রেখেছিলেন। লকডাউনের মধ্যে খাওয়ার খরচ জোগাতে সেই টাকাও চলে গিয়েছে সংসারের খাতে। খাই-খরচ চালাতে দিনে এক বারের বেশি চা-ও খাচ্ছেন না। যে বিড়ির বান্ডিলে এক বেলা চলত, তা এখন চার দিন চলছে। তেল মশলার খরচ বাঁচাতে গোটা পরিবারেরই ভরসা সেদ্ধ ভাত। সরস্বতীর পেটের রোগ বহু পুরনো। এলাকার হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছ থেকে ফি সপ্তাহে ওযুধ আনতে হয়। সরস্বতী বলে ওঠেন, ‘‘সপ্তাহে ৩০ টাকার ওষুধ। এই অবস্থায় ওই টাকাটাও ওষুধের পিছনে খরচ করতে গায়ে লাগে।” গত দুই সপ্তাহ ওষুধও খাননি সরস্বতী। তা নিয়ে অবশ্য বিশেষ আক্ষেপ নেই। তাঁর দুঃখ, ‘‘গ্রামের গয়লাবাড়ি থেকে নাতনির জন্য এক পো করে দুধ আনতাম। এখন দুধের ১২ টাকাও জোগাড় করতে পারছি না। নাতনিটা এমনিতে কিছুই খেতে চায় না। দুধটুকুই ভরসা ছিল।”
গত বছর পুজোর আগে কিস্তিতে কেনা মোটর ভ্যানটা বেচে দেওয়াই মনস্থ করেছিলেন দিলীপ। কিন্তু কিনবে কে? তায় আবার কিস্তির টাকা শোধ করে। ত্রিপলের ফাঁক গলে আসা মাখার উপর জ্বলন্ত সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে দিলীপ বলেন, ‘‘আমাদের গোটা পাড়াতেই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের বাস। সবারই একই রকম হাল। কার কাছে হাত পাতব?”

দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁধের গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দিলীপের প্রশ্ন, ‘‘আবার তো শুনছি মোদী বলেছে লকডাউন বাড়বে। আমাদের মতো মানুষ কত দিন রোজগার ছাড়া বাঁচবে?” নিজের প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ‌ফের বলে উঠলেন, ‘‘শুনছি করোনা চলে গেলে নাকি অনেকের কাজ থাকবে না? পাশের পাড়ায় কয়েকজন সোনার কাজ করে। ওদের তো বলে দিয়েছে লকডাউন উঠে গেলেও কাজে না যেতে।” তক্তপোষ থেকে উঠে বাইরের উঠোনে রাখা মোটর ভ্যানের সিটে হালকা চাপড় মেরে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দিলীপ বললেন, ‘‘যাই বলুন। আমার এই ভ্যানোর চাকা গড়ালে ঠিক কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই ক’টা দিন খালি কাটতে দিন।”
দিলীপ বোঝেন না অর্থনীতির গূঢ় কথা। তবে তিনি জানেন মোদ্দা কথা— কাজ থাকলে পয়সা আসবে। কিন্তু কাজটা থাকবে কি?

দিলীপের পাড়ায় যাওয়ার পথেই কথা হচ্ছিল রাজ্য শ্রম দফতরের এক কর্তার সঙ্গে। লকডাউনের বাজারেও সকাল থেকে টোটো করে ঘুরছেন। শুধোচ্ছিলেন চারপাশের হাল হকিকত। তাঁর কাছেই শুনছিলাম, সরকারি নির্দেশ মেনে অনেক বড় কোম্পানি লকডাউনের সময়ে বেতন দিয়ে দেবে শ্রমিকদের। কিন্তু সেই সঙ্গে সে সব কারখানার বড় কর্তারা ইতিমধ্যেই শুনিয়ে রেখেছেন, লকডাউন উঠলে কোম্পানি বাঁচাতে ছাঁটাই করতে হবে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের। শুনছিলাম ছোট সংস্থাগুলোর হাল নাকি আরও খারাপ। শ্রমিকদের বেতন দেওয়া দূরের কথা, খোদ মালিকেরই বেহাল দশা। তাঁর দেওয়া হিসেবটা খুব একটা জটিল নয়। কাজ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে কমবে চাহিদা। মানুষের হাতে টাকা থাকবে না। কমে যাবে ক্রয় ক্ষমতা। ফলে সরাসরি যাঁরা কাজ হারাবেন না, তাঁদেরও কমে যাবে কাজের সুযোগ।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা করোনা পরবর্তী সময়ে দেশে কাজ হারাবেন প্রায় ১৩ কোটি মানুষ। এঁরা প্রত্যেকেই অসংগঠিত শ্রমিক। গোটা দেশে এই অসংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যাটা প্রায় ৩৭ কোটি। তাঁদেরই এক জন হুগলির দিলীপ। এঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ইএসআইয়ের মতো সামাজিক সুরক্ষা নেই। কিন্তু সময়ের চাহিদা মেনে রয়েছে ঋণ। দিলীপের মোটর ভ্যানের মাসিক ২ হাজার ৭০০ টাকা কিস্তি ছাড়াও রয়েছে ছেলের স্মার্ট ফোনের কিস্তি। কোনওটাই পরের মাসে দিতে পারবেন বলে আশা করছেন না দিলীপ। আর সেটাই তাঁর চিন্তা। ঋণের টাকা দিতে না পারলে বেহাত হয়ে যেতে পারে রোজগারের মূল রাস্তা।

অর্থনীতির ভাষায় দিলীপ হচ্ছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের একজন স্বনিযুক্ত শ্রমিক। দিলীপের মতো অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই স্বনিযুক্তি শব্দটা খাটে না। সেই তালিকায় রয়েছেন ক্ষেত মজুর, অটো-টোটো-ভ্যান চালক, গৃহ পরিচারক-পরিচারকা, ইট ভাটার কর্মী, কুলি, ফেরিওয়ালার মতো হাজারো পেশার মানুষ। যাঁদের অনেকেরই নির্দিষ্ট কোনও রোজগার নেই। আমাদের রাজ্যে সেই সংখ্যাটাই সাড়ে তিন কোটি থেকে চার কোটি। রাজ্যের শ্রম দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী— এক কোটির সামান্য কিছু বেশি অসংগঠিত শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত আছে সরকারি খাতায়। যদিও সংখ্যাটা নথিভুক্ত সংখ্যার আড়াই গুণ বেশি বলে জানালেন শ্রম দফতরের এক শীর্ষ কর্তা। এর মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রের অসংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা ধরা নেই। রাজ্য কৃষি দফতরের কাছে এখনও সঠিক কোনও সংখ্যা নেই কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের। তবে কৃষি দফতরের এক আধিকারিকের হিসাবে ওই সংখ্যা এক থেকে দেড় কোটি।

দিলীপ শোনাচ্ছিলেন, মোটর ভ্যানের আগে তাঁর ছিল সাইকেল ভ্যান। তারও আগে, প্রায় ২৪ বছর আগে তাঁত বুনতেন। বেগমপুরী শাড়ি। একটা শাড়ি বুনলে মিলত ৬০ টাকা। বুনতে সময় লাগত গোটা দিন। এখন রোজগার ঢের বেশি। দিলীপের এই রোজগার অবশ্য সরকারি হিসাবে ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত বাজার দরের নিরিখে।

২০১৭-১৮ সালের বাজার দরের নিরিখে ৩৭৫ টাকা ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত বলে জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক। কিন্তু ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময়ের বাজার দর আর বর্তমান বাজার দরেও ফারাক অনেক। গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সব্জির দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। ডাল বা ডাল থেকে তৈরি খাবারের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি প্রায় ১৭ শতাংশ। ডিম, মাছ মাংসের মতো প্রোটিনজাত খাবারের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী— স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ক্ষেত্রেও খরচ বেড়েছে ৪ শতাংশ।

শতাংশের হিসাব নিয়ে মাথা না ঘামালেও, লকডাউনে বাজারের যে দাম বিস্তর বেড়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দিলীপ। মোটর ভ্যানের ইঞ্জিনের গায়ে লেগে থাকা ধুলো হাতের গামছা দিয়ে পরম মমতায় মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, ‘‘এর পর কী হবে? কাজ না থাকলে তো না খেয়ে মরতে হবে।” বলতে বলতে গলাটা কেঁপে উঠল দিলীপের। অশনি সঙ্কেত দেখছেন দেশ জুড়ে কোটি কোটি দিলীপরা।

গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy