Advertisement
১৮ জানুয়ারি ২০২৫
Coronavirus

অনুভবের পার্বণে আমরা কেউ একা নই

আচ্ছা, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে, আপনি কেন পারছেন না বন্ধনডোরটাকেই ‘মুক্তি’ হিসেবে ভাবতে?

বিসর্জনের পরে মণ্ডপে বিষাদের সুর।  ছবি: শুভেন্দু চাকী

বিসর্জনের পরে মণ্ডপে বিষাদের সুর। ছবি: শুভেন্দু চাকী

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যিক
শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২০ ০২:৩৬
Share: Save:

মা লক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখে শেষ রাতের ঘুম ভেঙে গেল কেন আপনার? এই ঘোর দুঃসময়ে লক্ষ্মীর আগমন তো সুসংবাদ! বুঝেছি, আপনি ঘামছিলেন, কারণ দেখলেন যে, লক্ষ্মী কোনও ঘরে ঢুকতে পারছেন না, যে হেতু করোনার ভয়ে কেউ নিজের চৌকাঠের বাইরে আলপনা আঁকেনি। এ বার কি তা হলে রাস্তাতেই থাকবেন দেবী, আর মানুষ আটকে থাকবে খাঁচার টিয়া হয়ে? আপনার প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর কারও কাছে নেই, কারণ মহামারিতে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৫০ লক্ষের কাছাকাছি, হয়তো বা কোটি ছুঁয়ে ফেলবে ক’দিন পরেই। এই অলাতচক্র ঘুরতে ঘুরতে কোথায় থামবে কেউ জানে না। তবে ইদ কিংবা বিজয়া দশমীর কোলাকুলি শিগগির ফিরে আসার আশা খুব কম। আচ্ছা, তা হলে কি বারো মাসে তেরো পার্বণ বন্ধই হয়ে গেল? দোলের দিন কেউ না-ওঠা রং মাখায়নি জাপটে ধরে, পয়লা বৈশাখে একটাও হালখাতার নেমন্তন্নে গিয়ে গজা আর সন্দেশ খাননি, টিভির সামনে বসে দেখছিলেন ইস্টারের বিশ্ব জুড়ে কেবল বেদনারই পুনর্জন্ম হচ্ছে। তা হলে কোথায় আর উৎসবের আলো? বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে শনিমন্দির আর তার দশ পা দূরে ওলাবিবিতলা। আপনি ছোট থেকে জেনে এসেছেন, এই দুটো পুজোর সিন্নিই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খেতে হয়, ঘরে আনতে নেই। কিন্তু আজ তো মানুষ অদৃশ্য কার্নিস থেকে হাওয়ায় ঝুলছে, মহামারি তার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়ে দু’ঠোঁটে দিয়ে গিয়েছে একটাই শব্দ, “মুক্ত করো…।”

আচ্ছা, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে, আপনি কেন পারছেন না বন্ধনডোরটাকেই ‘মুক্তি’ হিসেবে ভাবতে? মনে করুন তো শেষ কবে মায়ের হাতে পাখার বাতাস নিয়েছেন ষষ্ঠীর দিন সকালে? অফিসের তাড়ায় তখন বলে আপনার…! এ বার কিন্তু ওই হাতপাখার গা থেকে ঝরে পড়া বিন্দু বিন্দু জল, দুশ্চিন্তায় ব্লাস্ট-ফার্নেস হয়ে থাকা আপনার মাথাটাকে একটু আরাম দিতে পারে! আর সেই আবেশে চোখ বুজে আসলে খেয়াল করতে পারেন, কত দিন আলো আর মণ্ডপ আর চেকোস্লোভাকিয়ার জিমন্যাস্টের আদলে তৈরি মূর্তি দেখার নেশায় আপনি ভুলেই গিয়েছেন সেই পটচিত্রের কথা, যেখানে মাকে ‘দেখে দেখে আঁখি না ফিরে?’ সব চেয়ে বড় দুর্গা দেখার জেদে ট্র্যাফিক ধসিয়ে না দিয়ে কুলুঙ্গির ঝুল ঝেড়ে ওই পট এক বার হাতে নিয়ে দেখবেন নাকি? আর পট নামাতে গিয়ে যদি ছোট্ট গোপালের মাথার পরচুলা খুলে পড়ে, তা হলে ভেবে দেখবেন, কত দিন ধরে ওই বালক হাত ঘুরিয়েই চলেছে, কিন্তু আপনার ওকে নাড়ু খাওয়ানোর কথা খেয়ালই হয়নি!

আচ্ছা, এ বার যে যার বারান্দায় ঝুলন করলে কেমন হয়? সেই সুদূর ছোটবেলায় যেমন করতেন? আজকের বাচ্চারাও জানুক কেমন করে বালি দিয়ে পাহাড়, সুরকি দিয়ে রাস্তা, কয়লার গুঁড়ো দিয়ে জঙ্গল আর জগের জল দিয়ে নদী বানিয়ে আপনারা শৈশবেই জেনে গিয়েছিলেন, পৃথিবীটা ছোট নয়, বড়।

আরও পড়ুন: কেরল এবং রাজস্থান থেকে বিশেষ ট্রেনে ফিরছেন রাজ্যের আটকে থাকা শ্রমিকরা

আমেরিকার ক্যানসাসে ল্যারি স্টুয়ার্ট বলে এক জন থাকতেন, যিনি ছোট কাঠের বাক্সে রাত কাটানো মানুষের জন্যও বড় করে ভাবতেন, অসহায় দরিদ্র মানুষকে লুকিয়ে সাহায্য করতেন, আজীবন। আটান্ন বছর বয়সেই পৃথিবীর পাট চুকিয়ে ফেলেন স্টুয়ার্ট আর মৃত্যুর পরে তাঁর কাজের কথা প্রকাশ্যে এলে সহনাগরিকেরা তাঁকে ডাকতে শুরু করেন ‘সিক্রেট সান্তা’ বলে। এই ছটফটানিটা কি একটু কমবে, যদি আপনিও গুপ্ত সান্তার মতো লক্ষ্মীকে এমন কারও ঝোলায় কিছু ক্ষণের জন্য রেখে আসেন, আলপনা দেখলেই যার ফেনাভাতের কথা মনে পড়ে শুধু?

গাছের পাতার পুজো হতে দেখেছেন আপনি সাঁওতাল গ্রামে গিয়ে। সেই পুজো এখন শহরেও আদায় করে নিচ্ছে প্রকৃতি; চারপাশের গাছগুলো কত ঝলমলে হয়ে উঠেছে দেখুন, দূষণহীনতায়। মনে মনে হারিয়ে যেতে পারলে আমাদের চার চাকার কী দরকার বলুন? এই যে ঘর থেকে বেরোননি কত দিন, কে বলতে পারে, বাইরেটা বিলকুল বদলে গেছে কি না! হয়তো এসপ্লানেডের কাছেই এখন গাঁদা আর সন্ধ্যামণি ফুলে ঘেরা সেই খাড়া পাথর, যা টাঁড়বারোর দেবস্থান। বুনো মহিষের দেবতা টাঁড়বারোকে মনে নেই? বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর পৃষ্ঠা থেকে তিনি কলকাতা শহরে এসে দাঁড়িয়েছেন পশু-পাখিদের পাব্বনে যোগ দিতে। আপনি না-হয় আজ চার দেওয়ালের ভিতর থেকেই অনুভব করলেন, পৃথিবীটা আসলে অনেকের। সেই অনুভবের চাইতে বড় কোনও পার্বণ হয় বলুন?

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেনআপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy