চিঠি-পাল্টা চিঠিতে অব্যাহত সঙ্ঘাত। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীকে লম্বা এবং কড়া চিঠি লিখলেন জগদীপ ধনখড়।
আরও ঘনীভূত হল সঙ্ঘাতের মেঘ। মুখ্যমন্ত্রীর কড়া চিঠির জবাবে বৃহস্পতিবার রাতেই পাল্টা চিঠি লিখেছিলেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রী নিজের সাংবিধানিক কর্তব্যকে ধারাবাহিক ভাবে অবহেলা করছেন বলে রাজ্যপাল অভিযোগ করেছিলেন সে চিঠিতে। কিন্তু সেখানেই থামল না চিঠি-পর্ব। শুক্রবার আরও লম্বা এবং আরও কড়া চিঠি লিখলেন জগদীপ ধনখড়। সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুললেন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। রাজ্যে করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ বলে দাবি করে রাজ্যপাল আঙুল তুললেন মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। মুখ্যমন্ত্রীর গোটা কৌশলটাই সেই ‘ব্যর্থতা’র দিক থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা— এমনই বিস্ফোরক কথাবার্তা এ দিন লিখলেন রাজ্যপাল।
২৩ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির জবাবে তিনি যে একটি চিঠি (৫ পৃষ্ঠার) পাঠিয়েছিলেন, সে কথা ২৪ এপ্রিলের চিঠির শুরুতেই উল্লেখ করেছেন রাজ্যপাল। এ দিনের ১৪ পাতার চিঠিটি ওই চিঠির পরবর্তী পর্ব বলে জানিয়েছেন তিনি। তার পরে নিজেকে রাজ্যের ‘প্রথম সেবক’ আখ্যা দিয়ে (যে ভাবে মোদী নিজেকে ‘প্রধান সেবক’ আখ্যা দেন) রাজ্যপাল লিখেছেন, এই সঙ্কচের সময়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চান এবং সেই লক্ষ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতা চাইছেন। রাজ্যপালের কথায়, ‘‘রাজ্যের সব রাজনৈতিক দল দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। আপনার জন্যও এখন রাজনীতি বন্ধ রাখার সময়।’’
এর পরের স্তবক থেকেই আরও আক্রমণাত্মক হয়েছেন রাজ্যপাল। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি বুঝতে পারছি যে, পশ্চিমবঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এবং প্রতিরোধে আপনার যে বিশ্রী ব্যর্থতা, সে দিক থেকে জনগণের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই আপনার গোটা কৌশলটা রচিত হয়েছে।’’ তার পরের লাইনে রাজ্যপাল লিখেছেন, ‘‘আপনার সংখ্যালঘু তোষণ এতই প্রকাশ্য এবং বেমানান যে, এক সাংবাদিক যখন আপনাকে নিজামউদ্দিন মরকজের ঘটনা নিয়ে একটা প্রশ্ন করলেন, তখন আপনার প্রতিক্রিয়া ছিল— আমাকে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করবেন না।’’ রাজ্যপালের কথায়, ‘‘এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আপনার বোঝা উচিত যে, এক জন অপরাধীকে কখনও এক জন আক্রান্তের অবস্থানে রাখা যায় না।’’
আরও পড়ুন: একাধিক অভিযোগে রাজ্যকে জোড়া চিঠি কেন্দ্রীয় দলের
Sent response @MamataOfficial to her communication.
— Governor West Bengal Jagdeep Dhankhar (@jdhankhar1) April 24, 2020
Hope good sense prevails now and all move in togetherness to deal with the challenges state is facing so that people in deep distress get some solace.
এ দিনের চিঠিতে বার বার মুখ্যমন্ত্রীকে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা এবং সীমারেখার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে ৫ পৃষ্ঠার চিঠি পাওয়ার পরে যে পাল্টা ৫ পৃষ্ঠার চিঠি রাজ্যপাল লিখেছিলেন, তাতেও রাজ্যপাল ওই একই কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। শুক্রবারের চিঠিতে আরও বিশদ ব্যাখ্যায় গিয়ে রাজ্যপাল লিখলেন, ‘‘আমাদের দায়-দায়িত্ব আমাদের সংবিধানে নির্দিষ্ট করা আছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনাকে সংবিধান অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং রাজ্যপাল হিসেবে আমার কাজ সংবিধানকে রক্ষা করা এবং রাজ্যের মানুষের সেবা করা। রাজ্যপালের প্রতি আপনার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা সংবিধানেই রয়েছে। দুঃখের বিষয়, আপনি ধারাবাহিক ভাবে তার সম্পূর্ণ অবমাননা চালিয়ে যাচ্ছেন।’’
মোট ৩৭টি পয়েন্টে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন রাজ্যপাল। চিঠির ষষ্ঠ পয়েন্টে মুখ্যমন্ত্রীর একটি মন্তব্যকে তুলে ধরে রাজ্যপাল দাবি করেছেন, দেশের সংবিধানের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর কোনও শ্রদ্ধা নেই। তিনি লিখেছেন, ‘‘যন্ত্রণার বিষয় হল, আপনার কার্যকলাপ সংবিধানের জন্য চূড়ান্ত অবমাননাকর এবং আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিয়েছি যে— সংবিধানে এবং এই রাজ্যের ও জাতির মহানতায় যিনি বিশ্বাস রাখেন, তিনি ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’-এর বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের দ্বারা গণভোট নেওয়ার কথা কখনও ভাবতেই পারবেন না। আপনি ভাবতে পেরেছিলেন এবং তখনও আমি আপনাকে সতর্ক করেছিলাম।’’
বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি লিখেছিলেন রাজ্যপালকে, তাতে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ ছিল। মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি আক্রমণ করা, অন্য মন্ত্রীদের এবং আধিকারিকদের সরাসরি আক্রমণ করা, যে সরকারের তিনি রাজ্যপাল, সেই সরকারের বিরুদ্ধেই সাংবাদিক সম্মেলন করা, অসংসদীয় ভঙ্গি এবং ভাষায় কথা বলা— এমন নানা অভিযোগ তুলে তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিনের চিঠিতে রাজ্যপাল তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ নস্যাৎ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী শুধু অভিযোগই করেছেন, অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে কোনও ঘটনার কথা তুলে ধরেননি বলে রাজ্যপাল লিখেছেন এই ১৪ পাতার চিঠিতে।
এতেই শেষ নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ দিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের তুলনা টেনেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। তিনি লিখেছেন, বিধানচন্দ্র রায় নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান ছিলেন। ধনখড়ের কথায়— কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, একজন মুখ্যমন্ত্রীর কেমন হওয়া উচিত, তা বিধানচন্দ্র রায় সব রকম ভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আজ ওই রকম মুখ্যমন্ত্রীকেই প্রয়োজন কিন্তু দুঃখজনক ভাবে তেমন আর দেখা যায় না— খোঁচা দিয়েছেন ধনখড়।
আরও পড়ুন: রাজ্যের প্রতিনিধির অপেক্ষায় কেন্দ্রীয় দল, করোনা পরিস্থিতি পরিদর্শন নিয়ে জটিলতা
চিঠির নির্বাচিত অংশ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রাক্তন ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে তুলনা টানা এটুকুতেই থামিয়ে দেননি রাজ্যপাল। তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘ভাবুন, বিধানচন্দ্র রায় বা তাঁর মতো কেউ আজ থাকলে, কোভিড মোকাবিলায় কী ভাবে কাজ করতেন! কী রকম উদ্যম, সততা, নিষ্ঠা, সহানুভূতি এবং সঙ্কল্প নিয়ে তিনি আজ রাজ্যের মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, ভেবে দেখুন!’’ এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হত না, রাজনীতি চলত না, জনগণের অর্থ লুঠ হত না, গণবণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে কেলেঙ্কারি হত না— লিখেছেন রাজ্যপাল। মানুষ যাঁকে ভালবেসে ‘দিদি’ বলে ডাকেন, তিনি কি তাঁর রাজ্যের জনগণের সঙ্গে ঠিক কাজ করছেন? প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যপাল।
দীর্ঘ চিঠিতে কোথাও করোনায় আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা ‘লুকিয়ে রাখা’র অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন রাজ্যপাল। কোথাও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ না মানা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। রাজ্যের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যে কেন্দ্রীয় দল এসেছে, সেই দলের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করার অভিযোগও তুলেছেন।
বৃহস্পতিবার রাজ্যপালকে পাঠানো চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধৃত করেছিলেন বি আর অম্বেডকরকে। সংবিধান রচনার সময়ে ‘রাজ্যপাল’ পদ সম্পর্কে অম্বেডকরের পর্যবেক্ষণ কেমন ছিল, মুখ্যমন্ত্রী সে কথা নিজের চিঠিতে তুলে ধরে বুঝিয়েছিলেন যে, রাজ্য সরকারের কাজে নিরন্তর হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাজ্যপালের নেই। মুখ্যমন্ত্রীর সেই কথার জবাব এ দিনের ১৪ পৃষ্ঠার চিঠিতে দিয়েছেন রাজ্যপাল। অম্বেডকরের যে কথাগুলো মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেছিলেন, সেগুলোকে রাজ্যপাল খণ্ডন করেননি। কিন্তু লিখেছেন, ‘‘কী বৈপরীত্য— সংবিধানকে অকেজো করতে এবং সংবিধানের গলা টিপে ধরতে অম্বেডকরকে ডেকে আনা হচ্ছে।’’
চিঠির ২৫ নম্বর পয়েন্টে রাজ্যপালের অভিযোগ— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্যকলাপ ‘অসাংবিধানিক’ এবং ‘সঙ্ঘাতপন্থী’। রাজ্যপাল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সঙ্ঘাতে যাওয়ার এই প্রবণতা প্রমাণ করে যে তিনি আইন মানেন না এবং কাউকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পছন্দ করেন না— এমনই লিখেছেন রাজ্যপাল। চিঠির শেষ বাক্যে রাজ্যপাল লিখেছেন, ‘‘রাজভবনে আপনার এক জন বন্ধু রয়েছে, যিনি জনগণের স্বার্থে সব সময়েই সহযোগিতায় প্রস্তুত এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে তৈরি।’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy