ক্রেতার দেখা নেই মধ্য কলকাতার রঙের বাজারে। নিজস্ব চিত্র
মধ্য পঞ্চাশের প্রশান্ত পালের বাড়ি হাওড়ার আন্দুলে। কাজের সূত্রে কলকাতায় আসতে হয়েছে। সেই ফাঁকেই পৌঁছে গিয়েছিলেন জানবাজারে, যেখানে ফুটপাতের ধারে সারি সারি রঙের দোকান। বেশ দরদস্তুর করে নানা রঙের আবির কিনলেন প্রশান্তবাবু। যদিও তাঁর মতো ক্রেতা এবার কমই জুটছে সাহেব সাউ, হরিহর সাউদের।
ফি বছর দোল বা হোলির ১০-১২ দিন আগে থেকেই ফুটপাথের ধারে অস্থায়ী দোকান দেন ওঁরা। নানা রকমের রং আর পিচকারি থেকে শুরু করে আবির, বেলুন সবই মেলে এই দোকানগুলিতে। দোলের দিন যত এগিয়ে আসে, সরু ফুটপাথে পা রাখার জায়গা পাওয়া দায় হয় রং-ক্রেতাদের ভিড়ে। কিন্তু, এ বছর ছবিটা অনেকটাই আলাদা। সারি সারি দোকান, রং-বেরঙের পসরা থাকলেও ক্রেতা নেই। সাহেব সাউয়ের কথায়, ‘‘এ বছরের মতো দোলের আগে রঙের খারাপ বিক্রি বহু দিন দেখিনি। কী সব চিন থেকে রোগ এসেছে। আর তার জন্য সব লোক ভয় পেয়ে রং-আবির কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন।” পাশের দোকানি সুধীর। তিনি বললেন, ‘‘মোবাইলে সব খবর আসছে, রং মাখলে রোগ হবে। তাই এ বার লোকজন রং কিনতেও চাইছেন না।” বোঝা গেল, ভারতে দু’ডজনেরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে সোশ্যাল মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যমের খবরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে শহর কলকাতাতেও।
মধ্য কলকাতার বাসিন্দা অনিল শুক্ল। রঙের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজেই দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, ‘‘আতঙ্ক হবে না কেন বলুন তো? আমিও তো প্রতি বছর হোলি খেলি। ওটা আমাদের সবচেয়ে জোরদার পরব। কিন্তু এ বার রং-আবির কিচ্ছু খেলব না। আত্মীয়-বন্ধু যাঁরা আসবেন, তাঁদের শুধু ঠান্ডাই দেব।” অনিল এর পর একটা দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে পিচকারি হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘‘এ সব পিচকারি, বেলুন এমনকি রংও সব মেড ইন চায়না। কোন ভরসায় এ বার দোল খেলব?” পকেট থেকে একটি আর্সেনিকাম অ্যালবাম-৩০-এর শিশি বের করে অনিল বলেন, ‘‘সব সময় এই ওষুধ সঙ্গে রাখছি। সবাই বলছে করোনা এই ওষুধে রোখা যাবে।”
আরও পড়ুন: প্রতিষেধক নেই, করোনা মোকাবিলায় কী ভাবে প্রতিরোধ বলয় গড়ছে রাজ্য?
অনিলের ঠিক উল্টো মত প্রশান্তবাবুর। তাঁর দাবি, ‘‘আমি রং কিনছি না। আবির কিনলাম। দোল একটা আনন্দের দিন। করোনার ভয়ে ওই দিনের আনন্দ মাটি করতে পারব না। তা ছাড়া রং বা আবির থেকে করোনা ছড়ায়, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। বরং মুরগির মাংস থেকে ও সব ছড়াচ্ছে। বাড়িতে আমি মুরগি খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছি।”
কিন্তু, প্রশান্তের থেকে যে অনিলদের পাল্লা ভারী তা বোঝা যায় মধ্য কলকাতার জোড়াসাঁকো, পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াবাগান এলাকায় গেলে। প্রতি বছর হোলির দিন এখানকার রাস্তাও ঢেকে যায় আবিরে। সেখানকারই বাসিন্দা বছর তিরিশের ঋষিকেশ বাপনা। হোলিতে রং খেলবেন কি না প্রশ্ন করায় খানিকটা দোনামনা করেই বলেন, ‘‘এ বছরটা ভাবছি বাদ দেব। কোথা থেকে কী হয়ে যায়। তার পর মোদীজি তো বলছেন, এ বার তিনিও হোলিতে কোনও জমায়েতে যাবেন না।” ঋষিকেশের বন্ধু সাগর সুতোদিয়া। প্রতি বছর হোলির দিন তিনি পরিবার নিয়ে বা বন্ধুদের সঙ্গে শহরের কোনও না কোনও হোলির জমায়েতে যান। যেমন, গত বার গিয়েছিলেন নলবনের একটা অনুষ্ঠানে। সেখানে দিনভর রং খেলা, নাচ-গান করে, খাবার খেয়ে বিকেলে ফিরেছিলেন। কিন্তু, এ বার তিনিও ঠিক করেছেন বাড়িতেই থাকবেন।
সাগরের মতো মানুষদের সংখ্যাটা যে কম নয়, তা বোঝা গেল শহরের বেশ কয়েক জন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কর্তাদের কথাতেই। দোল উপলক্ষে নানা রঙিন ইভেন্টের চল এই শহরে বেড়েছে বেশ কিছু বছর ধরেই। অভিজাত প্রমোদকাননে বা কোনও ‘অ্যামিউজমেন্ট ডেস্টিনেশন’-এ আয়োজিত সেই সব ‘হোলি পার্টি’তে প্রথম দিকে দেখা যেত শুধু সেলিব্রিটি আর উচ্চবিত্তের লোকজনকেই। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, শহরে ততই বেড়েছে এই ধরনের পার্টির সংখ্যা। গত কয়েক বছরে সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালেও চলে এসেছে দিনভর হোলি-হুল্লোড়ের এই সব আয়োজন। এ বছর আচমকা ধস সেই উৎসাহে। গত বছরের সাড়ার কথা মাথায় রেখে যাঁরা এ বারের ‘হোলি পার্টি’র আয়োজন করেছিলেন, এ বার তাঁদের মাথায় হাত পড়ার জোগাড় হয়েছে।
সোমবার এখানেই হওয়ার কথা হোলি-পার্টি ‘রং ধনুষ’। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: একাধিক রাজ্যের বহু জায়গায় ঘুরেছেন ইতালির পর্যটকরা, করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে আরও
নিউটাউনের একটি ‘অ্যামিউজমেন্ট ডেস্টিনেশন’ আগামী সোমবার দোলের দিন সকাল থেকে বেলা ৩টে পর্যন্ত চলার কথা ‘রং ধনুষ’ নামে একটি পার্টির। রং, খাওয়া-দাওয়া, বারবিকিউ, ঠান্ডাই, লস্যি— সব দায়িত্ব আয়োজকদের। সঙ্গে উপরি রেন ডান্স, লাইভ ডিজে, কিডস্ পুল, নানা রকম গেমস্। মাথাপিছু খরচ ৭০০ টাকারও কম। আয়োজক সংস্থা ‘ইভেঞ্চুরাস ইভেন্টস ফর লাইফ’-এর আশা ছিল, এত কম খরচে এই রকম পার্টিতে অংশ নিতে পারার সুযোগ লুফে নেবে শহুরে মধ্যবিত্ত। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। টিকিট প্রায় বিক্রিই হচ্ছে না। যত জনের অংশগ্রহণের কথা মাথায় রেখে ইভেন্টের আয়োজন করেছিল সংস্থাটি, দোলের দিন তিনেক আগেও সাড়া মিলেছে তার অর্ধেক। সংস্থার তরফে রণিৎ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘যত টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলাম, তার ৫০ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। মাঝে আর মাত্র কয়েকটা দিন। এর মধ্যে বাকি ৫০ শতাংশ টিকিট কী ভাবে বিক্রি হবে জানি না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ইভেন্ট তো কোনও ভাবেই বাতিল করতে পারব না। যত জনই আসুন, পার্টি হতেই হবে। তবে এ বার হোলির পার্টি নিয়ে উৎসাহে এই রকম ভাটা পড়বে জানলে, আয়োজন ছোট করেই করতাম।’’
এ সবের মধ্যেই অবশ্য অ্যাকোয়াটিকার জেনারেল ম্যানেজার গৌরব গোস্বামীর দাবি, ‘‘আমাদের ৯ মার্চ অনুষ্ঠান। আমরা তো ভাল সাড়া পাচ্ছি।” অ্যাকোয়াটিকাতে প্রায় ২ হাজার লোকের আয়োজন করা সম্ভব। তবে গৌরব জানিয়েছেন, তাঁরা ৫০০ জনের আয়োজন করেছেন। একই সুর মৌমিতা কুণ্ডুর। তিনি দোলের আগের দিন একটি ‘টিম’ নিয়ে ট্রেনে করে দোল খেলতে যাচ্ছেন পুরুলিয়ার নিমডি-তে। মৌমিতা বলেন, ‘‘আমরা তো সবার কাছ থেকে খুব ভাল সাড়া পাচ্ছি। করোনাভাইরাস নিয়ে কোনও রকম আতঙ্ক দেখছি না। কেউ আমাকে ফোন করে ট্যুর বাতিল করার কথাও বলেননি।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইভেন্ট ম্যানেজার অবশ্য অন্য কথা বলেন। তিনি নিজে প্রতি বছর নিউটাউনের একটি অভিজাত আবাসনে ডিজে-রেন ড্যান্স সহযোগে হোলির অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকেন। তাঁর কথায়, ‘‘অধিকাংশ আয়োজকরাই ব্যবসার কথা ভেবে সত্যিটা স্বীকার করছেন না। অনেক আবাসন এবং ক্লাবেই এ বার অনুষ্ঠান হচ্ছে না।’’
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎসাহে এই ভাটা করোনা আতঙ্কের কারণেই। এক বিশ্লেষকের কথায়, ‘‘হোলির দিন যে সব ইভেন্ট হয়, তার টিকিট বিক্রি সাধারণত খুব আগে থেকে হয় না। দোলের কাছাকাছি এসে বিক্রিতে জোয়ার আসে। উৎসাহীরা শেষ ক’দিনেই খোঁজ নিয়ে নেন যে, কোথায় কী ইভেন্ট রয়েছে। তার পর কোনও একটা ডেস্টিনেশন বেছে নেন। কিন্তু এ বার দোলের কাছাকাছি এসে করোনা আতঙ্ক যে ভাবে বেড়ে গেল, তাতে আর টিকিট বিক্রি হওয়া কঠিন।’’
আরও পড়ুন: দিল্লি পুলিশের বাধা, বাধ্য হয়ে গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই সংসদে পৌঁছলেন ক্ষুব্ধ অধীর
বড়বাজারে রঙের যাঁরা পাইকারি ব্যবসা করেন, তাঁরাও স্বীকার করছেন যে, দোল খেলার সরঞ্জামের বেশিটাই ইদানীং চিন থেকে আসায় আতঙ্ক বেড়েছে। রামলোচন মল্লিক স্ট্রিটের এক আবির প্রস্তুতকারক সংস্থার মালিক বলেন, ‘‘রং বা আবিরের সঙ্গে আদৌ করোনাভাইরাসের কোনও যোগ আছে কি না জানি না। তবে, মানুষ কিছু না জেনেই আতঙ্কিত হয়েছেন। আমাদের এ বারের বিক্রি দেখেই তা বুঝতে পারছি।”
সেই সঙ্গে অনেকেই যে করোনা আতঙ্ক থেকে হোলি বা দোলের দিনে জমায়েত এড়াতে চাইছেন, আর সেটাই যে হোলির বাজারে মন্দা ডেকে এনেছে, তা মেনে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy