কৃষ্ণনগর সার্কিট হাউসের এই ঘরেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। —নিজস্ব চিত্র
দিন চারেক আগেই খবরটা এসে পৌঁছে গিয়েছিল— সার্কিট হাউসে আসছেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। রাতে থাকবেন।
স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর খাবার রান্নার দায়িত্ব পড়ল আমার উপরেই। সার্কিট হাউসে রান্না করার সুবাদে দেশের অনেক বড়-বড় নেতামন্ত্রীকে রান্না করে খাওয়ানোর সুযোগ আমার হয়েছে। ফলে সে ভাবে টেনশন না হলেও একটা উদ্বেগ কাজ করছিল।
দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে কথা! শুনেছি, মানুষটা খেতে ভালোবাসেন। রান্না ঠিকঠাক হবে তো? আমাকে বলা হয়েছিল, তিনি নিরামিষ খাবার খাবেন। তাঁর জন্য মেনু ঠিক করতে হল আমাকেই। এর আগেও উনি এসেছেন। জানতাম, উনি ভাত আর রুটি দুটোই খান। তাই ঠিক করলাম ভাত-রুটি দুটোই দেব। উনি যেটা পছন্দ করবেন, সেটাই খাবেন।
ভাত-রুটির সঙ্গে থাকবে ডাল, পাঁচমিশালি সব্জি, ছানার তরকারি, ছানার ডালনা, টক দই। সঙ্গে সরপুরিয়া আর সরভাজা। দু’দিন ধরে তখন সার্কিট হাউস জুড়ে চরম ব্যস্ততা। বড়-বড় অফিসারেরা আসছেন-যাচ্ছেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুঁটিয়ে দেখছেন।
পুরনো সার্কিট হাউসে ‘ভাগীরথী’ ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে রাখা হল। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি। দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ সার্কিট হাউসের ভিতরে ঢুকল তাঁর কনভয়। দূরে দাঁড়িয়ে মানুষটাকে দেখলাম। এর আগেও তিনি এসেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর মধ্যে এতটুকু পরিবর্তন দেখলাম না।
কৃষ্ণনগর সার্কিট হাউসের ভিজিটর্স বুকে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সই। নিজস্ব চিত্র
১৯৯৬ সালে এসেছিলেন দলের মিটিংয়ে বিজেপি নেতা সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের হয়ে প্রচারে। যতটুকু মনে পড়ছে, মিটিং হয়েছিল কারবালা মাঠে। তার পর ১৯৯৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি এলেন সরকারি কর্মসূচিতে গভর্নমেন্ট কলেজ মাঠে। মিটিং শেষে তিনি ঢুকলেন সার্কিট হাউসে। সোজা ঢুকে গেলেন ঘরে। বাইরে নিরাপত্তারক্ষীরা। খানিক পরে জানানো হল, অটলবিহারীজি চা খাবেন। দুধ চা। তাড়াতাড়ি দুধ চা বানিয়ে ঢুকলাম তাঁর ঘরে। ধীর-স্থির ভাবে তিনি বসে আছেন। টেবিলে চা রেখে বেরিয়ে এলাম।
শুরু হল রান্নার প্রস্তুতি। একে একে সব পদ রান্না সারা হল। সব কিছু গুছিয়ে রাখা হল। সাড়ে ৯টা নাগাদ জানানো হল, এ বার তিনি খাবেন। একে-একে সমস্ত খাবার নিয়ে গিয়ে রাখা হল ওঁর ঘরের টেবিলে। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই দেখলাম, মানুষটা খুব চুপচাপ। কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলেন না। চোখে মুখে একটা হালকা হাসি-হাসি ভাব। এক বারও দেখে মনে হল না, এই মানুষটাই নাকি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর খাওয়া শেষ হলে বাসন গুছিয়ে নিয়ে এলাম।
পরের দিন সকালেই তিনি বেরিয়ে যাবেন। তাই খুব ভোরে উঠেই ঢুকে গেলাম রান্নাঘরে। এ বারও সেই রুটি, সব্জি, আর কিছু ফল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম মানুষটাকে কাছ থেকে দেখব বলে। নিরাপত্তারক্ষীদের তেমন কড়াকড়ি ছিল না। সামনে দিয়ে উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমি দু’হাত জোড় করে নমস্কার করলাম। উনি হিন্দিতে বললেন, “ভাল থাকবেন।’’
আমি তো ভালই আছি। কিন্তু মানুষটা চলে গেলেন। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ সার্কিট হাউসেরই এক কর্মী এসে আমাকে বললেন, ‘‘টিভিতে দেখাচ্ছে, মারা গিয়েছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।’’ শুনেই মনটা বড় ভার হয়ে গেল। ঐ হাসি-হাসি মুখটা বড্ড মনে পড়ছে। আর কোনও দিন ওঁর জন্য রান্না করতে হবে না।
লেখক রাঁধুনি, কৃষ্ণনগর সার্কিট হাউস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy