এই বিজ্ঞাপন ঘিরেই বিতর্ক। ছবি: টুইটার
লক্ষ্মীপুজোর আগের বিকেলে তাঁর মাসি, মেসো তাহমিনা বানু, মহম্মদ জাকারিয়ার কথা বলছিলেন ইতিহাসবিদ অমিত দে। “মাসি, মেসো তো আমার বোনকে লক্ষ্মী বলেই আদর করতেন। সেই লক্ষ্মীর মধ্যে তো ধর্ম নয়, ওঁদের স্নেহ, ভালবাসারই প্রকাশ! ভাষা তো ভাষাই হয়। ভাষার মধ্যে জোর করে ধর্ম টেনে আনা কেন?”
মঙ্গলবার দিনভর একটি সর্বভারতীয় পোশাক ব্র্যান্ডের দেওয়ালির বিজ্ঞাপনে উর্দু ‘শব্দদূষণের’ অভিযোগ এবং দেশ জুড়ে তোলপাড়ের পটভূমিতেই এত কথা উঠে এল। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে-র পুত্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের আশুতোষ অধ্যাপক অমিতবাবুর মামার বাড়ি শেখ ফজলুল হকের পরিবার। এ দেশের আরও অজস্র লোকের মতো হিন্দু, মুসলিম সংস্কৃতির নানা ধারাই সমান তালে এসে মিশেছে তাঁদের জীবনে। সমাজমাধ্যমে একটি চেনা পোশাক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন নিয়ে কারও কারও ক্ষোভ দেখলে অবশ্য দীর্ঘদিনের এই মেলামেশার সংস্কৃতি ভুলে যেতে হবে। বিজ্ঞাপনটিতে আলোর উৎসবকে (দীপাবলি বা দেওয়ালি) স্বাগত জানিয়ে নতুন পোশাকের সম্ভার মেলে ধরা হচ্ছে, যার নাম রাখা হয়েছিল ‘জশন-এ-রেওয়াজ’! তাতেই বিজেপির আগুনখেকো যুব নেতা তেজস্বী সূর্য হিন্দু উৎসবের এব্রাহামিকরণ বা ইসলামিকরণের অভিযোগে গর্জে উঠেছেন। কেউ উর্দু গন্ধে নাক সিঁটকোচ্ছেন তো
কেউ বিজ্ঞাপনের মডেলদের কপালে টিপ না-থাকা 'অহিন্দু-কাণ্ড' বা 'ম্লেচ্ছাচার' বলে সরব। ব্র্যান্ডটিকে বয়কটের ডাক ওঠায় তারা বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে নিয়েছে। ধর্ম-জিগির তুলে বয়কটের ডাক এ দেশে এখন আকছার ঘটে। তবু টুইটারে, ফেসবুকে পাল্টা ক্ষোভের সুরও শোনা যাচ্ছে, ‘আমরা ভারতীয়েরা গঙ্গা, যমুনা তেহজিবের শরিক’! কেউ বা বলছেন, ‘ভাষা নদীর মতো সব শব্দকেই আপন করে। তা কারও ধান্দাবাজির সঙ্কীর্ণ পুকুর নয়’! তেজস্বী সূর্যের খাঁটি হিন্দুয়ানিকে বিঁধে বলা হচ্ছে, এত ছুতমার্গ থাকলে তিনি তো সেলাই করা জামা গায়ে না-দিয়ে প্রাচীন হিন্দু রীতি মেনে পিরান গায়ে দিতে পারেন। “জশন-এ-রেওয়াজ মানে পরম্পরা বা ঐতিহ্য পালনের খুশি। শব্দগুলো ফার্সি, উর্দু শব্দভাণ্ডারে রয়েছে”, বলছিলেন মৌলানা আজাদ কলেজে ফার্সির বিভাগীয় প্রধান ইফতেকার আহমেদ। বাস্তবিক রেওয়াজ তো বটেই বাংলা, হিন্দির আইন, আদালত, কাগজ, কলম সর্বত্র ফার্সি, উর্দু বা কিছুমিছু আরবিও মিশে রয়েছে। ইফতেকার সাহেবের কথায়, “এ দেশের হিন্দু, মুসলিমের ভাষা, সংস্কৃতি মানেই যৌথতার প্রকাশ। বাঙালিরা পুজোর পরে কোলাকুলি করেন, তাও সেমিটিক সমাজের আলিঙ্গনের রীতি থেকে এসেছে। জোর করে সব আলাদা করলে হাতে থাকবেটা কী?” ইতিহাসবিদ অমিতবাবুও মনে করাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথও বাংলা ভাষায় ফার্সি, আরবি শব্দকে বহু বার স্বাগত জানিয়েছেন। রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন প্রমুখ অনেকের মধ্যেই ফার্সি, উর্দু সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ছিল। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁর সঙ্গীত জীবনের বইটির নামই রাখেন তহজীব-এ-মৌসিকী। অমিতের কথায়, “ভাষা নিয়ে ছুতমার্গও এক ধরনের দ্বিজাতিতত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা। এটা স্পষ্টতই ফাটল ধরানোর রাজনীতি। এ দেশের বহুত্বের আদর্শে এটা মেলে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy