পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কলেজবেলার ছবি-সহ সেই জমির দলিল। নিজস্ব চিত্র
দেখামাত্র অব্যর্থ ভাবে চিনে ফেলার প্রয়োজনেই দলিল দস্তা বেজে যথাসম্ভব সাম্প্রতিক ছবি দেওয়া হয়। কিন্তু বছর দশেক আগে একটি জমির দলিলে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কলেজবেলার ছবি দেখে তদন্তকারীরা রীতিমতো তাজ্জব বনে গিয়েছেন। তাঁদের প্রশ্ন, এ কোন পার্থ? অতি পুরনো সেই ছবির সঙ্গে এখনকার পার্থের কোনও মিলই যে প্রায় নেই!
সেই ছবি থেকেও নতুন সন্দেহ ও ধন্দে পড়েছে ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। ইডি-র একাংশের প্রশ্ন, পরিচিতি আড়াল করতেই কি প্রাক্তন মন্ত্রী ইচ্ছা করে পুরনো ছবি দিয়েছেন? শুধু ওই দলিলে নয়, তল্লাশিতে পাওয়া অন্যান্য দলিলেও পার্থের পুরনো ছবি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ইডি-র তদন্তকারীরা। দলিলে পার্থের সই নিয়েও তাঁরা অত্যন্ত সন্দিহান। সত্যিই কি সেটা পার্থের সই, সন্দেহ দেখা দিয়েছে ইডি-কর্তাদের মনে। পার্থের সইয়ের সঙ্গে সেটি মিলিয়ে দেখারও কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইডি।
তদন্তকারীদের দাবি, উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডের দুই বাসিন্দার কাছ থেকে শান্তিনিকেতনের শ্যামবাটি মৌজার ফুলডাঙার ১৯২৯ খতিয়ানের ওই সাত কাঠা জমি যৌথ ভাবে কেনেন পার্থ ও অর্পিতা। ইডি-কর্তারা জানাচ্ছেন, নিয়মনীতি অনুযায়ী যে-কোনও জমি কেনাবেচার দলিলে ক্রেতা-বিক্রেতার সাম্প্রতিক ছবি দেওয়ার কথা। অথচ ২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি তৈরি এক জমি হস্তান্তরের দলিলে পার্থের যে-ছবি দেওয়া হয়েছিল, সেটি দেখে তাঁকে চেনাই দায়! ইডি-কর্তাদের অনুমান, সেটি ওই অভিযুক্তের ৩৫-৪০ বছর আগের সাদা-কালো ছবি। সেই সময় হয় তিনি কলেজে পড়তেন বা কলেজের গণ্ডি ছাড়িয়ে সবে চাকরিতে ঢুকেছেন। আজকের পার্থের সঙ্গে বা ২০১২ সালের পার্থের সঙ্গে সেই ছবির মিল খুবই কম। খুঁটিয়ে না-দেখলে সহজে তাঁর সাম্প্রতিক চেহারার সঙ্গে কোনও মিল পাওয়া যাবে না। পার্থ ছাড়াও তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায় এবং জমির দুই বিক্রেতার সাম্প্রতিক ছবি সেই দলিলে ব্যবহার করা হয়েছে।
ওই দলিলে সই ছাড়াও নিয়ম অনুযায়ী আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছিল। দলিলে বাকি তিন জনের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু পার্থের আঙুলের ছাপ খুবই অস্পষ্ট এবং তা নিয়ে ধোঁয়াশাও রয়েছে। তাই সই ও আঙুলের ছাপ যাচাই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীদের।
এমন সন্দেহ কেন?
ইডি-র বক্তব্য, অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে পারেন এঁরা। হতে পারে, বিশেষ অভিসন্ধি থেকেই দলিলে নিজে সই না-করে পুরনো ছবি দেওয়া হয়েছে, যাতে কখনও পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ালে বলে দিতে পারেন যে, তিনি ওই দলিল সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ জানতেন না! তাঁকে অন্ধকারে রেখে সব করা হয়েছে।
ইডি-র দাবি, জেরার মুখে পার্থ জানিয়েছেন, অর্পিতার সঙ্গে তাঁর আলাপ বেশি দিনের নয়। তদন্তকারীদের প্রশ্ন ছিল, আলাপ কত দিনের? কারও সঙ্গে কেউ যদি ২০১২ সালে যৌথ ভাবে জমি কেনেন, তা হলে ধরে নিতে হবে, আলাপটা তার বেশ কিছু দিন আগেই হয়েছে। দু’জনের মধ্যে তত দিনে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলেই নিশ্চয়ই আইনি দলিলে নিজেদের ছবি দিয়ে তাঁরা যৌথ ভাবে জমি কিনছেন।
তদন্তকারীদের অভিযোগ, ২০১২-র জানুয়ারিতে পার্থ ও অর্পিতার নামে ওই জমি কেনা হলেও ওই বছরেরই ডিসেম্বরে ভূমিরাজস্ব দফতরে শুধু অর্পিতার নামে জমিটির ‘মিউটেশন’ বা নামপত্তন করিয়ে নেওয়া হয়। তদন্তকারীদের বক্তব্য, আইনত দু’জনের নামেই মিউটেশন করার কথা। দু’জনের এক জন যদি তাঁর অংশ অন্যকে উপহার দিচ্ছেন বলে পৃথক ‘গিফট ডিড’ বা উপহার দলিল করেন, তা হলে এক জনের নামে মিউটেশন সম্ভব। তখন জমির মালিকানা হয়ে যাবে উপহার প্রাপকের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত ওই দফতর থেকে এমন কোনও গিফট ডিডের নথি পাওয়া যায়নি।
আরও একটি বিষয়ে ধোঁয়াশা আছে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, পার্থ ও অর্পিতাকে দু’টি লোক শনাক্ত করেছেন বলে দলিলে উল্লেখ রয়েছে। এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁদের মধ্যে এক জনের ঠিকানা আলিপুর পুলিশ কোর্ট, থানা: আলিপুর। তদন্তকারীদের অভিযোগ, প্রথমত, ওই ব্যক্তির নামের পাশে পেশায় আইনজীবী বলে কোনও পরিচয় লেখা নেই। তা ছাড়া ‘আলিপুর কোর্ট’ কোনও ব্যক্তিরই স্থায়ী ঠিকানা হতে পারে না।
তদন্তকারীদের দাবি, এত ত্রুটি কী ভাবে ভূমিরাজস্ব দফতরের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের নজর এড়িয়ে গেল, সেটা বড় প্রশ্ন। যে-দলিল নিয়ে এত প্রশ্ন, তার সঙ্গে বোলপুরের অতিরিক্ত জেলা ভূমিরাজস্ব দফতরের তৎকালীন এক কর্তার নামও জড়িয়ে গিয়েছে বলে ইডি সূত্রের খবর।
ইডি-র বক্তব্য, সাধারণ নিয়মগুলি কোনও ভাবেই ভূমিরাজস্ব দফতরের অফিসারদের নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। প্রতিটি বিষয়ে খুঁটিনাটি পরীক্ষা করেই দলিল তৈরি করা হয়। ২০১২ সালে পার্থ ছিলেন শিল্পমন্ত্রী, অত্যন্ত প্রভাবশালী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, প্রভাবশালী বলেই কি নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে ওই দলিল তৈরি করা হয়েছিল? সংশ্লিষ্ট অফিসের তৎকালীন আধিকারিকের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy