রোগে যত না কাবু হয়েছিলেন, সেরে উঠে বেশি ভেঙে পড়েছেন বিরাটির সুব্রত সমাদ্দার!
পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই সুব্রতবাবুর সদ্য অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়েছে। মাঝে-মধ্যে বুকে চিনচিনে ব্যথা হতো, অল্পে হাঁফিয়ে উঠতেন। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, স্টেন্টের দাম পড়বে দেড় লাখ টাকা। দ্বিতীয় মতামত নিতে যাঁর কাছে গেলেন, তিনি জানালেন, আরও উন্নতমানের স্টেন্ট রয়েছে, যা বসালে আরও বেশি ভাল থাকা যাবে। তবে খরচ দু’লাখ ছাড়াবে।
ধারদেনা করে ‘বেশি ভাল’ স্টেন্টই লাগিয়েছেন বিরাটির ওই শিক্ষক। কিন্তু চেনা-পরিচিতদের মুখে এখন শুনছেন, এত বাড়তি খরচের নাকি দরকার ছিল না, সাধারণ স্টেন্টে দিব্যি কাজ চলত।
সেই ইস্তক ফের যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সুব্রতবাবু। তাঁর মতো দশা অনেকেরই। কখনও সংশ্লিষ্ট ডাক্তারবাবু, কখনও বিক্রেতা সংস্থার এজেন্ট, কখনও বা অ-চিকিৎসক কর্মীরাও রোগীদের বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ। বস্তুত চিকিৎসকদের একাংশের মতে, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি ঘিরে যে রকম বিভ্রান্তি, ডাক্তার-রোগী সম্পর্কে যেমন অবিশ্বাস, অন্য কোনও ক্ষেত্রে ততটা দেখা যায় না।
দুর্গাপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ারম্যান তথা হৃদ্রোগ চিকিৎসক সত্যজিৎ বসু বলেন, ‘‘দু’টো কথা খুব প্রচলিত। অন লেভেল, আর অফ লেভেল। স্টেন্ট বসানোটা সত্যিই জরুরি হলে অন লেভেল। না হলে, অফ লেভেল।’’
কী রকম?
চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা: ধরা যাক, হার্ট অ্যাটাকের দু’ঘণ্টার মধ্যে রোগী হাসপাতালে পৌঁছলেন। স্টেন্ট বসল। এটা অন লেভেল। কিন্তু কদাচিৎ বুক চিনচিন, ছোট বা মাঝারি ব্লক ধরা পড়ল, আর তাতেই স্টেন্ট বসে গেলে অফ লেভেল। ‘‘অফ লেভেলের কেস দিন দিন বাড়ছে। কারণ, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। প্রতিবাদ করলে বিপদে পড়ার আশঙ্কা।’’— মন্তব্য সত্যজিৎবাবুর।
চিকিৎসকদের অনেকের কণ্ঠেই আক্ষেপের সুর। যেমন বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট শুভানন রায়ের দাবি, ইউরোপ-আমেরিকায় স্টেন্ট বসানোর প্রশ্নে নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে, যা এ দেশে নেই। এবং সেটাই বড় সমস্যা। তাঁর কথায়, ‘‘ইদানীং বহু ডাক্তার আধুনিক প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে খুব দামী স্টেন্ট বসাতে চাইছেন, যেগুলো নিয়ে হয়তো তেমন সমীক্ষাই হয়নি।’’ অন্য এক বেসরকারি হাসপাতালের হৃদ্রোগ বিভাগের প্রধান সুনীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, স্টেন্ট-প্রযুক্তিতে অগ্রগতির সঙ্গে জটিলতাও বেড়েছে। ‘‘অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি মানে শুধু স্টেন্ট বসিয়ে দেওয়া নয়। তা কীসে তৈরি, আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ঠিকঠাক কিনা, বসানোর পরের প্রতিক্রিয়া— সবই যুক্ত। তাই গবেষণা বা সমীক্ষা বেশি হয়েছে, এমন সব স্টেন্ট বসানো উচিত।’’— মত সুনীপবাবুর।
স্টেন্টের দামের সঙ্গে উৎকর্ষও কি বাড়ে?
এমন তত্ত্বের সমর্থন অবশ্য বিশেষ মিলছে না। মুকুন্দপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের হৃদ্রোগ-চিকিৎসক দেবদত্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কম দাম মানেই খারাপ নয়। আবার দামি বিদেশি স্টেন্টই চাই, এমনটাও নয়। ভাল ভারতীয় স্টেন্টও আছে। সুবিধা-অসুবিধা বুঝিয়ে রোগীর পরিবারের কাছে ডাক্তারেরই জানতে চাওয়া উচিত, তাঁরা ঠিক কী চান।’’
এ দিকে সরকারি হাসপাতালে স্টেন্ট বসালে যে খরচ, বেসরকারিতে তার বেশ কয়েক গুণ! এতটা ফারাক কেন?
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসকের ব্যাখ্যা, প্রিন্টেড প্রাইসের একটু কমেই সাধারণত স্টেন্ট পাওয়া যায়। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল সেই ছাড়টা দেয় না। ‘‘ওখানকার খরচে হাসপাতালের মুনাফা, ডাক্তারের কমিশন— সব ধরা থাকে।’’— দাবি তাঁর। এ-ও আক্ষেপ, ‘‘ডাক্তারের কমিশনের ছোঁয়াচ সরকারি হাসপাতালেও লেগেছে। তাই সেখানেও ন্যায্য খরচের বেশি হচ্ছে।’’
অর্থাৎ স্টেন্ট নিয়ে সংশয়-বিভ্রান্তি-অবিশ্বাসের জাল কাটবে কী ভাবে, তার দিশা দেখা যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy