রেডিয়ো স্টেশনের অনুষ্ঠানে শ্রীমন্তী হেমব্রম। নিজস্ব চিত্র
মাধ্যমিক শেষ করার আগেই হয়েছিল বিয়ে। পুরুলিয়ার পুঞ্চার সে শ্রীমন্তী হেমব্রমই এখন নাবালিকার বিয়ে রোখেন পরিবারকে বুঝিয়ে। কোনও কিশোরীর পড়া বন্ধ হতে যাচ্ছে শুনে, সাহায্যে করেন। কানে কোনও সমস্যা এলে, মেটানোর চেষ্টা করেন এই ‘রেডিয়ো জকি’।
এক দশকের বেশি পুঞ্চার লৌলাড়ায় ‘নিত্যানন্দ জনবাণী কমিউনিটি রেডিয়ো সেন্টার’-এ বাংলা ও সাঁওতালিতে মেয়েদের সমস্যার সমাধান, লোকসংস্কৃতি প্রসারের মতো নানা অনুষ্ঠান করে আসছেন বছর পঁয়ত্রিশের শ্রীমন্তী। পুঞ্চার আশপাশের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার বাসিন্দারা তা শুনতে পান। ইদানীং ইন্টারনেটেও তা ছড়িয়েছে।
বছর তিনেক আগে পুঞ্চার জলহরির অষ্টম শ্রেণির এক নাবালিকা রেডিয়ো স্টেশনের ‘ফেসবুক পেজ’-এ জানায়, বিয়ে ঠিক হয়েছে, কিন্তু সে পড়তে চায়। শ্রীমন্তীর কথায়, ‘‘রেডিয়োর মাধ্যমে মেয়েটির পরিবারকে বাল্যবিবাহের কুফল বোঝাই। পরদিন বাড়িতে গিয়ে মেয়ের বাবা-মাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করাই।’’ গত বছর সে নাবালিকা মাধ্যমিক পাশ করেছে। তার কথায়, ‘‘দিদি না থাকলে, জীবনটাই অন্য রকম হত।’’
বছর চারেক আগে রেডিয়ো সেন্টারে ফোন করে পুঞ্চার সনপুরার এক মহিলা শ্রীমন্তীকে জানান, তাঁর পড়শি বধূ অস্বাভাবিক আচরণ করায় পরিবার ওঝা ডাকছে। শ্রীমন্তী বধূটিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করায় ধরা পড়ে, হর্মোনজনিত রোগ হয়েছে তাঁর।
আর্থিক সমস্যায় পুঞ্চার ধগড়ার সবিতা সরেনের পড়া বন্ধ হতে বসেছিল। তাঁর কথায়, ‘‘শ্রীমন্তীদি বই-খাতা দিয়ে এবং স্কুলে গিয়ে কথা বলে পড়া বন্ধ হতে দেননি। ওঁর জন্যই নার্স হতে পেরেছি।’’
পুঞ্চার ধুলিয়াপাড়ায় বাপের বাড়ি। ১৬ বছর বয়সে বাঁকুড়ার হিড়বাঁধে বিয়ে হয়। বছর দু’য়েক পরে, স্বামীর সঙ্গে পুঞ্চায় আসা শ্রীমন্তী বলেন, ‘‘ছোট থেকেই নাটক, নাচ-গান করতাম। স্বামীর উৎসাহে ফের শুরু করি। বিয়ের ১৩ বছর পরে, মাধ্যমিকও দিই। আমার এক মাত্র মেয়ে কোয়েল এখন একাদশ শ্রেণিতে। ওকেও বলি, মেয়েদের জন্য আমাদেরই যা করার, করতে হবে।’’
সামাজিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের জন্য ‘ইউনিসেফ’-এর উদ্যোগে যখন পুঞ্চায় ওই কমিউনিটি রেডিয়ো সেন্টার চালু হয়, শ্রীমন্তী ‘রেডিয়ো জকি’র কাজ পান। ‘ইউনিসেফ’-এর পুরুলিয়ার অন্যতম কনসালট্যান্ট বিকাশরঞ্জন চক্রবর্তী ও রেডিয়ো স্টেশনের অন্যতম পরিচালক চণ্ডীদাস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দক্ষতার সঙ্গে অনুষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি, শ্রীমন্তি যে কত জনের পাশে দাঁড়িয়েছেন, হিসেব নেই।’’
শ্রীমন্তীর স্বামী সহদেব হেমব্রম নাটক লেখেন, নাটকের দলও চালান। ২০১৯-এ তাঁর রচিত নাটকে অভিনয় করে সরকারি পুরস্কার পেয়েছেন শ্রীমন্তী। সহদেব বলেন, ‘‘ও রেডিয়ো জকি। সমাজকর্মী। নাট্যকর্মী। আমার বন্ধু। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy