Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

অ্যাসিড-দগ্ধদের দ্রুত শংসাপত্র দিতে বোর্ড গড়ার নির্দেশ

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী অ্যাসিড-হামলায় ক্ষতিগ্রস্তকে দ্রুত তিন লক্ষ টাকা দিতে হবে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্তেরা সেই টাকা পাচ্ছেন না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩১
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী অ্যাসিড-হামলায় ক্ষতিগ্রস্তকে দ্রুত তিন লক্ষ টাকা দিতে হবে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্তেরা সেই টাকা পাচ্ছেন না। এমনকী এই ধরনের হামলায় তাঁরা যে সুস্থ মানুষ থেকে রাতারাতি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন, সেই আকস্মিক প্রতিবন্ধকতার সার্টিফিকেট বা শংসাপত্রও জুটছে না।

এই অবস্থায় অ্যাসিড-আক্রান্ত মহিলা ও পুরুষদের প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র দেওয়ার জন্য অবিলম্বে মেডিক্যাল বোর্ড গড়ার নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ওই বোর্ড গড়তে হবে। সেই সঙ্গে শীর্ষ আদালতের রায় মেনে অ্যাসিড-আক্রান্তদের ন্যূনতম তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং তাঁদের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ মিটিয়ে দিতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের বিশেষ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি।

কোথায় কী ভাবে মেডিক্যাল বোর্ড গড়তে হবে, সেই বিষয়েও নিজেদের অভিপ্রায় স্পষ্ট করে দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি দত্ত সরকারি কৌঁসুলিদের উদ্দেশে বলেন, জেলা হাসপাতালগুলিতে ওই বোর্ড না-গড়ে এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, নীলরতন বা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে যে-কোনও একটিতে তা গড়া হোক। মেডিক্যাল বোর্ড কবে, কখন বৈঠকে বসবে, তা জানিয়ে দিতে হবে মামলাকারীদের অথবা তাঁদের আইনজীবীদের।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, অ্যাসিড-হামলার ১৫ দিনের মধ্যে আক্রান্তকে এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিতে হবে ক্ষতিপূরণের প্রাথমিক কিস্তি হিসেবে। বাকি দু’লক্ষ টাকা মেটাতে হবে তিন মাসের মধ্যে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেই সময়সীমা মানা হচ্ছে না। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে দ্রুত আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য হাইকোর্ট এর আগেও নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকারকে। কিন্তু মনীষা পৈলান ও রীতা পাল নামে দুই মহিলা ক্ষতিপূরণের তিন লক্ষ টাকা পেলেও বাকিরা পাননি বলে অভিযোগ।

ক্ষতিপূরণের দাবিতে হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার অ্যাসিড-আক্রান্ত সাত জন মহিলা ও পুরুষ চলতি বছরের গোড়ায় উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। মনীষার আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু সিংহরায় জানান, মাস কয়েক আগে এই মামলার শুনানিতে অ্যাসিড-আক্রান্তদের প্রতিবন্ধকতা খতিয়ে দেখে শংসাপত্র দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সেই নির্দেশ দেওয়া হলেও অ্যাসিড-আক্রান্তদের সকলে এখনও শংসাপত্র পাননি। অথচ ওই-শংসাপত্র থাকলে অ্যাসিড-আক্রান্তেরা চাকরি এবং অন্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে বৈধ পথে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধে পেতে পারেন।

মামলাটি এ দিন ছিল ফের শুনানির জন্য ওঠে। সরকারি কৌঁসুলি তপন মুখোপাধ্যায় ও অসীম গঙ্গোপাধ্যায় আদালতে জানান, প্রতিবন্ধকতা খতিয়ে দেখার জন্য যে-ব্যবস্থা থাকা দরকার, বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে সব সময় তা মিলছে না। মামলার আবেদনকারীদের কৌঁসুলিরা জানান, শংসাপত্রের ব্যবস্থা করার জন্য আদালত গত এপ্রিলেই রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতরের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু আট মাসেও সর্বত্র সেই ব্যবস্থা হয়নি। ক্ষতিপূরণের টাকা বা চিকিৎসা খরচও পাননি অনেক অ্যাসিড-আক্রান্ত।

সরকারি কৌঁসুলিরা দাবি করেন, দু’টি ক্ষেত্রে অ্যাসিড-আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলাশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা শুনে বিচারপতি দত্ত নির্দেশ দেন, ‘‘আক্রান্তদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ক্ষতিপূরণের টাকা জমা পড়ল কি না, দেখুন। অবিলম্বে যাতে তা জমা পড়ে, সেটা নিশ্চিত করুন।’’

অ্যাসিড-আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল বোর্ড ও ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে হাইকোর্টের এ দিনের নির্দেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে অ্যাসিড ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া (এএসআফআই)। তাদের বক্তব্য, দ্রুত চিকিৎসা এবং সময়সীমা মেনে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য যথাসময়ে মেডিক্যাল বোর্ডের দেওয়া শংসাপত্র পাওয়া দরকার। ‘‘অনেকে আক্রান্তই হামলার দীর্ঘদিন পরেও কোনও রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। চিকিৎসার খরচও তাঁদের নিজেদেরই জোগাড় করতে হয়েছে অথবা কোনও সংগঠন তা জোগাড় করে দিয়েছে। এই রায়ের ফলে অন্তত চিকিৎসার টাকার জন্য অ্যাসিড-আক্রান্তের পরিবারকে চিন্তা করতে হবে না,’’ ওই সংগঠনের তরফে বললেন বিক্রমজিৎ সেন।

প্রশ্ন উঠছে, শীর্ষ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও অ্যাসিড-দগ্ধ মহিলা বা পুরুষের কাছে দ্রুত ক্ষতিপূরণের টাকা পৌঁছচ্ছে না কেন? যে-সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অ্যাসিড-আক্রান্তদের সাহায্য করে, তাদের অনেকের অভিজ্ঞতা, এ-সব ক্ষেত্রে যে দ্রুত সরকারি ক্ষতিপূরণ মেলে, সেই ব্যাপারে যথেষ্ট প্রচারই নেই। ‘হিউম্যান রাইটস ল নেটওয়ার্ক’ নামে একটি সংগঠনের তরফে অপরাজিতা বসু বললেন, ‘‘বাংলাতেই অ্যাসিড-আক্রান্ত এমন অনেক মহিলা রয়েছেন, যাঁরা জানেন না, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাঁরা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। পাবেন চিকিৎসার সব খরচও। সরকারেরই উচিত, বিভিন্ন থানা থেকে তাঁদের নাম সংগ্রহ করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।’’

অ্যাসিড-হামলার অসুখ বাড়ছে কেন, সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব তার সদুত্তর হাতড়াচ্ছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলারাই যে এর শিকার, সেই ব্যাপারে দ্বিমত নেই। তার মধ্যে আবার প্রেমপ্রণয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অ্যাসিড ছোড়ার ঘটনা বেশি। পুরনো রাগ থেকে পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার বিষয়টিও আছে। প্রতিকারের পথ মিলছে না। তবে রাজ্য মহিলা কমিশন মনে করছে, এই ধরনের হামলা ঠেকাতে আইন করে যত্রতত্র অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ করা জরুরি।

অন্য বিষয়গুলি:

Courts order Acid victim Committee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE