“আমার এই কাদামাখা সার হলো।
ধর্ম-মাছ ধরবো বলে নামলাম জলে
ভক্তি-জাল ছিঁড়ে গেল।
কেবল হিংসা নিন্দে গুগলি ঘোঙা
পেয়েছি কতকগুলো।
আমি বিল বুনে পাই চাঁদা পুঁটি
লোভ-চিলে লুটে নিল।”
এখানের কথাগুলো যেন এক আত্মসমীক্ষা, যেন এক আত্ম-ধিক্কার। এতবড় ভাবের পদ যিনি রচনা করেছেন তাঁর নাম যাদুবিন্দু গোঁসাই। হাওড়া কাটোয়া রেলপথে সমুদ্রগড়ের কাছে নসরতপুরের পাঁচলখি গ্রাম। এখানেই থাকতেন তিনি।আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ১৯১৬ সালে তাঁর দেহাবসান ঘটে। যাদুবিন্দু ছিলেন এক মস্ত প্রেমিক বাউল। বিন্দু ছিলেন তাঁর সাধন সঙ্গিনী। যাদু আর বিন্দু এই দুইয়ে মিলে যাদুবিন্দু নাম নেওয়া তাঁর। মূল নাম যাদবেন্দ্র। যাদু আর বিন্দু দুই নামের জোড়কলমে গাঁথা ভনিতায় নিজের সাধনসঙ্গিনীকে অমর করে রাখা।
লোকায়ত জীবন আর লোকসংস্কৃতির প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে মানুষের মনের মধ্যে। লোকায়ত জীবন আর সংস্কৃতির মূল ঝোঁক হল সমন্বয় প্রবণতা, সে সমন্বয় মানুষে মানুষে। জাতে-জাতে এমনকি ধর্মে ধর্মে, তাই লোকায়ত জীবনধারাজাত সংস্কৃতির প্রধান বীজমন্ত্র গানের ভাষায় এইভাবে ফুটে উঠেছে—
“মানুষ হয়ে মানুষ চেনো
মানুষ হয়ে মানুষ মাপো
মানুষ হয়ে মানুষ জানো
মানুষ রতনধন
করো সেই মানুষের অন্বেষণ।”
লোকায়ত সংস্কৃতির যে ধারায় নিজেকে নিয়োজিত করে যাদবেন্দ্র বিন্দুকে সঙ্গী করে হয়ে উঠেছিলেন যাদুবিন্দু—সেই ধারাকে বলা হয় ‘সহজিয়া’ সম্প্রদায়। এই ধারার অনুসারীরা লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চা তথা বাউল সাধনের জন্য একজন সঙ্গী অথবা সঙ্গিনী নির্বাচন করেন। তথাকথিত বিবাহ তাঁরা করেন না তবে সাধন-ভজনের সাথে গার্হস্থ্য জীবনের বেশ কিছু আচার পালনও করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রামের উচ্চবর্ণ সমাজ তাঁদের মেনে নিতে পারে না। তাই সংঘবদ্ধভাবে নিজেদের তৈরি আখড়াতে বসবাস করেন। শহুরে ভোগবিলাসে মত্ত বাঙালি ছেলে-মেয়েদের বাউল-ফকির গান আকৃষ্ট করে। আকৃষ্ট করে তাদের স্বাধীন জীবনযাত্রা ও যোগাযোগ আচ্ছন্নতা। কিন্তু অনেকে এটা লক্ষ করেন না যে, বাউলের গান আসলে উঠে আসে তাঁর জীবনচর্চা থেকে, সাধনভজন থেকে। গান আখানে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা নয়। গান তাঁর সাধনার অন্তর্গত। রসের কারবারি একজন বাউল রূপরঙের প্রকাশে রাগরাগিনীকে তাঁর সুরের বিস্তারে অনায়াসে ব্যবহারের যে দক্ষতা দেখান, তা তাঁরই চর্চিত জীবনকে যাপনের মধ্যে থেকে খুঁজে পান। এই গান সমাজের প্রান্তের।
একসময় অখণ্ড বাংলায়, পূর্ব ও পশ্চিম অংশের অনেক গ্রামে-নগরে লোকায়ত সংস্কৃতির আনুকূল্যে গড়ে উঠেছিল বহুতর গৌণধর্ম। এই সব মতগুলির উদ্ভব ও প্রসার মূলত নবদ্বীপ ও সংলগ্ন পূর্বস্থলীকে ঘিরে, অখণ্ড নদিয়ার নানা জনপদে এবং রাঢ়বঙ্গে এই সব সম্প্রদায়ের উদ্ভবে কোথাও ছিল ব্রাহ্মণ ও ইসলামের মিলিত শক্তি। কোথাও বা গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়া সাধনা, কোনও ক্ষেত্রে দল গড়েছেন রাজবংশীরা এককভাবে। কোথাও মতের প্রবর্তন করেছেন একজন মুসলিম সাধক। কেউ কেউ সম্প্রদায় গড়েছেন ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মণ বিরোধী মনোভাব থেকে, অনেক ক্ষেত্রেই এইসব লোকায়ত সাধনার শিষ্য হতেন হিন্দু ও মুসলসান যৌথভাবে। তাঁদের আদর্শ ছিল উদার মানবতন্ত্র। সেই প্রসঙ্গে চৈতন্যের ভাবমূর্তি ও প্রভাব অনেক গভীর ছিল। বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির নানা গোষ্ঠীর উদ্ভবে শ্রীচৈতন্যের ভাবধারার প্রভাব অপরিসীম।
এই গানের ঐশ্বর্য আকর্ষণ করেছিল সম্পূর্ণ নাগরিক ঘরানার ঠাকুর পরিবারকেও। যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ম্যলিয়ের পড়তেন, তিনি লালনের সখ্য সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। এঁকেছিলেন লালনের ছবি। যে ভুবনের স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন, নিজের ‘পড়শি’র কাছ থেকে, তার ভাগ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। রবীন্দ্রনাথের বহু গানে লালন ঘরানার ছাপ আছে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বাউল গানের সম্ভার প্রকাশিত হয়। পরে ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসে এবং লন্ডনের হিবার্ট লেকচারে (১৯৩০) রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাউলগানের রসসম্পদ ছুঁয়ে যান। বাউল তত্ত্ব বোঝাতে দু’একটি গানের ইংরাজি অনুবাদও করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ শিক্ষাবিদ কালীমোহন ঘোষকে একটি চিঠিতে লেখেন “তুমি তো দেখেছ শিলাইদহে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমিত। তারা গরীব। পোষাক পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজ ভাবে তারা ভাবতে পারতো।” রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি থেকে বোঝা যায় শুধু বাউলগানের ভাব ও সুরের অভিনবত্ব নয়, তার বাইরে এই মগ্ন সাধকদের সাধারণ জীবনযাপন, দারিদ্র্য সত্ত্বেও উন্নত চেতনাগত সম্পদ তাঁকে বেশি আকর্ষণ করেছিল।
“আমি সুখের নাম শুনেছিলাম
দেখি নাই তার রূপ কেমন!
আমার দুখনগরে বাটী, পরিবার দুঃখরাজার বেটি
দুজনে দুঃখে করি দিনযাপন।”
জীবন নিয়ে এমন চকিত পরিহাস বাউলকেই মানায়। দুঃখরাজার বেটি ছাড়া কেই বা মালা দেবে গরিব সর্বহারা শিল্পীকে। কেননা সাধক বাউল আর খাঁটি ফকিরের তো কোনও বিষয়বাসনা নেই। যে যা দেয় আপন গরজে তা নিতে বাউল ঝোলা পেতে দেয়। বাউলের ঘরণী তো গেরস্থালী করবার জন্য আসেননি। তাই স্নান করে সিঁথেয় সিঁদুর দেন না, হাতে শাঁখাপলা পরেন না। হাতে একটা সুতো বেঁধে গর্ব করে তাকে বলে ‘গৌরগয়না’। তাঁর ঘরে খাট-বিছানা নেই। তার রান্নার কেরামতি নেই। তার এই নেই রাজ্যে মাটিতেই আহার বিহার নিদ্রা। তারা বলে ‘হলে মাটি মলে মাটি’।—কেননা সন্তান তো ভূমিষ্ঠই হয় আর বাউলের মাটিতেই সমাধি। তবে কি বাউলের কিছুই নেই, সে সর্বহারা! মোটেই নয়। কারণ বাউলের যা আছে তা গড়পড়তা গৃহীর নেই, কেননা বাউলের মনের সম্পদ বিশাল। লালনের সাথে কথোপকথনের পর রবীন্দ্রগানেও প্রভাব পড়েছে বাউলমনের এই অপরিসীম সম্পদের-
“যেথায় থাকে সবার অধম
দীনের হতে দীন-
সেই খানেতে চরণ তোমার রাজে।
সবার পিছে সবার নীচে
সর্বহারাদের মাঝে।”
ফরাসি কবি ও চলচ্চিত্রকার পাসকাল দীর্ঘদিন ধরে বাউল নিয়ে কাজ করেছেন। লেখায় গানে চলচ্চিত্রে। তবে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের বাউল নিয়ে কাজ সবথেকে উল্লেখযোগ্য। যিনি বাউলচর্চা থেকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যান লালনের তত্ত্বভাসিত বাউলপদে। বাউলের যে ভাব, বাউলের যে আত্মানুসন্ধান তা পাওয়া যায় তাঁর নিরন্তর বাউল সঙ্গ ও সন্ধানে।
কি আছে বাউল ভাবে? বাউল বলে,
“ঘটে পটে দিও না রে মন
পান কর সদা প্রেমসুধা
অমূল্যরতন।”
বাউল বলে, এই প্রেমসুধা জগতে এনেছিলেন তিন পাগল অদ্বে-নিতে-চৈতে। অদ্বে অর্থাৎ অদ্বৈত গোঁসাই, নিতে-নিত্যানন্দ, চৈতে তো চৈতন্যদেব। কিন্তু বাউলের কাছে এরা কেউই দেহধারী মানুষমূর্তি নন, এক একটা ভাব। রজবীর্যের সঙ্গমে জেগে ওঠে অদ্বৈত ভাব। নিতাইয়ের ভাব পেতে গেলে চাই নিত্যানন্দ অর্থাৎ দেহ সংগঠনের নিত্য আনন্দ। তবে পরিশেষে জাগবে চৈতন্যভাবে। বাউল চায় মায়ার অষ্টপাশ থেকে মুক্ত হতে। সে যে একেবারে একা।
বাউলের ক্রিয়াকলাপের গভীর বিস্তার তার দর্শনে, জীবনের গভীরে প্রোথিত থাকে। একজন প্রকৃত বাউল তার সাধনভজনার কারণেই সুরতালের প্রত্যন্ত প্রদেশে বিচরণ করতে পারে। বাউল সর্বদা নিজের ভাবের খোঁজ করে চলে। তারা যাদুবিন্দুর পথানুসারী, সদাই আত্মানুসন্ধানী। ফি বছর সমুদ্রগড়ের পারুলডাঙায় পদ্মপুকুর পাড়ে ভরা শীতে দিন কয়েক ধরে চলে বাউলমেলা। সারা বাংলা জুড়ে থাকা যাদুবিন্দুর অনুগামীরা আসেন ভাবের আদান-প্রদানে। বাউল ভাবের খোঁজে।
লেখক স্কুলশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy