Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Gangajalghati

বিদ্যুৎকেন্দ্রের বারান্দায় শিক্ষার আলো

করোনা-কালে বাঁকুড়ার মেজিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সে ‘কোচিং সেন্টার’ যেন হয়ে উঠেছে এলাকার দুঃস্থ পড়ুয়াদের ‘স্কুল’।

পড়ুয়াদের সঙ্গে রতনকুমার ঘোষ।

পড়ুয়াদের সঙ্গে রতনকুমার ঘোষ। নিজস্ব চিত্র।

তারাশঙ্কর গুপ্ত
গঙ্গাজলঘাটি শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২১ ০৫:০৮
Share: Save:

দুঃস্থ পড়ুয়াদের জন্য অবৈতনিক ‘কোচিং সেন্টার’ খোলা হয়েছিল অনেক বছর আগে। করোনা-কালে বাঁকুড়ার মেজিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সে ‘কোচিং সেন্টার’ যেন হয়ে উঠেছে এলাকার দুঃস্থ পড়ুয়াদের ‘স্কুল’। তাদের পড়ানোর টানে অবসরের পরেও বাড়ি ফেরা হয়নি মালদহের বাসিন্দা, ডিভিসির প্রাক্তন কর্মী বছর চৌষট্টির রতনকুমার ঘোষের। স্থানীয় লটিয়াবনি অঞ্চল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উজ্জ্বল রায় বলেন, ‘‘রতনবাবুর কাছে পড়া ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে বরাবর ভাল ফল করে। দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয়, সে ব্যাপারে উনি সজাগ।’’

১৯৯০ সালে মেজিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মসূত্রে আসেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার রতনবাবু। এক দিন সহকর্মীদের আড্ডায় এলাকার দুঃস্থ পড়ুয়াদের কথা ওঠে। রতনবাবু ঠিক করেন, বিকেলে অফিসের ছুটির পরে, এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের নিখরচায় পড়াবেন। তাঁর সঙ্গে পড়াতে রাজি হন কয়েক জন সহকর্মীও। ২০০২ সালে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির দুঃস্থ পড়ুয়াদের নিয়ে শুরু হয় তাঁদের কোচিং সেন্টার।

রতনবাবুর কথায়, ‘‘তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে পাশে পেয়েছি বলেই অফিসের বারান্দায় পড়ানোর অনুমতি মিলেছে। এখন পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ৭৩ জন পড়ছে। আমি অঙ্ক শেখাই। অন্য বিষয়ের জন্য সহকর্মীদের ডেকে আনি। এই কোচিং সেন্টারের অনেক প্রাক্তনীও এখন পড়াতে আসছেন।’’

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় কয়েক মাস কোচিং সেন্টার বন্ধ ছিল। সে সময়ে সমস্যায় পড়া পড়ুয়ারা আবাসনে গিয়ে রতনবাবুর কাছে পড়া দেখিয়ে নিত। পেশায় দিনমজুর এক অভিভাবক স্বপন লোহার বলেন, ‘‘টিউশনে পড়ানো বা স্মার্টফোন— সবার ক্ষমতায় কুলোবে না। রতনবাবু বিনা পয়সায় পড়াচ্ছেন বলেই মেয়েকে দশম শ্রেণিতে পড়াতে পারছি।’’ সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা দিনমজুর নিমাই বাউড়ি বলেন, ‘‘রতনবাবু ছিলেন বলেই আমাদের ছেলেমেয়েগুলো স্কুল বন্ধ থাকার সময়েও পড়াশোনা ভোলেনি।’’ এলাকাবাসীর দাবি, ওই কোচিং সেন্টারের বহু প্রাক্তনী আজ প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে রতন বাল্যবিবাহও আটকেছেন বেশ কয়েকটি।

তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাক্তন সুপারিন্টেডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার অচিন্ত্যকুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ডিভিসি-র সে সময়ের সামাজিক একীকরণ প্রকল্পে রতনবাবুকে সাহায্য করা হয়েছিল। উনি বিরাট কাজ করছেন।’’ ২০১৭-র জুনে, অবসরের পরে, রতন যাতে এলাকা না ছাড়েন, সে আবেদন করেন পড়ুয়া, অভিভাবক ও সহকর্মীদের একাংশ। শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ রতনকে কোচিং সেন্টার চালানোর জন্য আবাসনে থাকার ছাড়পত্র দেন।

তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার বিজি হোলকার বলেন, ‘‘রতনবাবু ডিভিসি-র গর্ব। অনেক গ্রামে শুনি, বহু দুঃস্থ অভিভাবক ছেলেমেয়েদের এই অবৈতনিক কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাতে চান।’’

ভাল ফল করা পড়ুয়াদের মধ্যে যারা ট্রেনে চাপেনি, তাদের নিয়ে ট্রেনে ঘুরতে যান রতন। পাহাড়ে চড়ার প্রশিক্ষণ দেন। করোনায় সব বন্ধ। তাই মাঝেমধ্যে সাইকেল নিয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। অকৃতদার রতন বলেন, ‘‘ওরাই আমার সব। যত দিন পারব, ওদের পড়িয়ে যাব।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Gangajalghati Coaching centre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy