মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বছরখানেক আগে স্পেন সফরে গিয়ে ‘লা লিগা’র প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘প্রেসিং ফুটবল’ শিখে এসেছিলেন কি না, কেউ জানেন না। কিন্তু কাকতালীয় হলেও সত্যি যে, জার্মানিতে ইউরো কাপে যখন স্পেন সবচেয়ে বেশি ‘প্রেসিং ফুটবল’ খেলছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা ভোটের পরে রাজ্য প্রশাসনে ‘প্রেসিং ফুটবল’ শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা!
অনেকের মতে, মমতার এই প্রশাসনিক তৎপরতার নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্ক। যে অঙ্ক তিনি কষছেন দু’বছর পরের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে। সেটা যে ‘স্বভাবিক’, তা মেনে নিচ্ছেন শাসক শিবিরের অন্দরের লোকজন। কিন্তু যা প্রণিধানযোগ্য, বিরোধী শিবির যখন ‘খলনায়ক’ খুঁজতে এবং নিজেদের মধ্যে বিবিধ কোন্দলে ব্যস্ত, তখন মমতা নিজের রক্ষণে বল ধরে সামনে এগোতে শুরু করে দিয়েছেন। সোমবারেও রাজ্যের সমস্ত পুরসভার মেয়র এবং চেয়ারম্যানদের বৈঠকে ডেকেছেন তিনি। প্রতিটি বৈঠকেই ‘আগ্রাসী এবং আক্রমণাত্মক’ মমতাকে দেখছেন প্রশাসনিক কর্তারা।
গত মঙ্গলবার নবান্নে রাজ্যের সমস্ত মন্ত্রী, সচিব, পুলিশকর্তা এবং জেলাশাসককে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন মমতা। তার পরে গত বৃহস্পতিবার পুরনিগমগুলির মেয়র, বিভিন্ন দফতরের কর্তা ও পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার আবার তিনি বৈঠক করবেন রাজ্যের সমস্ত পুরসভার চেয়ারম্যানের সঙ্গে (ঝালদা ও তাহেরপুর বাদে)। এক সপ্তাহের মধ্যে এ হেন তিন বৈঠক ঘিরে আন্দোলিত রাজ্য প্রশাসন। যে আলোড়ন প্রশাসনিক স্তর পেরিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের রাজনীতিকেও। লোকসভা ভোটের ফলাফলের বিশ্লেষণ বলছে, রাজ্যের ৯২টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। যে সংখ্যাটা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে বেশি। সেই কারণেই মমতা ‘ফাঁকফোকর’ বোজানোর কাজে নেমে পড়েছেন। কারণ, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁকে যেতে হবে ১৫ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পরে। অর্থাৎ, ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সঙ্গে নিয়ে। লোকসভা ভোটে বাংলায় বড় জয় পেয়েছে তৃণমূল। বিজেপির আসনসংখ্যা এবং ভোট শতাংশ কমেছে। কিন্তু তেমনই শহরাঞ্চলে ভোট কমেছে তৃণমূলের। ফলে মমতা পুলিশ, প্রশাসন, পুরসভা— ‘ত্রুটি’ চিহ্নিত করে ধারাবাহিক পদক্ষেপ করতে শুরু করেছেন।
প্রসঙ্গত, শাসকদলের অন্দরের খবর, সরকারের বিভিন্ন কাজে ‘অখুশি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি একটি এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্ট করে সংগঠন থেকে ‘ছোট বিরতি’ নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন তিনি। যার ব্যাখ্যায় অভিষেকের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল, কেন শহরাঞ্চলে খারাপ ফল হল, তার জবাবদিহি প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। অভিষেক চান, কাজ করতে না পারলে দায়িত্বপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধি, আমলা, এমনকি মন্ত্রীদেরও সরিয়ে ‘বার্তা’ দেওয়া হোক। সরকার যদি তার কাজের ফাঁক না পূরণ করে, তা হলে শুধু সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিরোধীদের মোকাবিলা করা যাবে না। ঘটনাচক্রে, অভিষেকের ওই পোস্টের পর থেকেই নবান্ন একের পর এক পদক্ষেপ শুরু করেছে। ওই পোস্টে অভিষেক লিখেছিলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করছেন, যাতে প্রতিশ্রুতি মতো ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আবাস যোজনার টাকা উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে যায় এবং বাড়ি তৈরি শুরু হয়। উল্লেখ্য, তার পরেই নবান্ন আবাস যোজনা নিয়ে সমীক্ষা শুরু করেছে।
মমতা যখন প্রশাসনিক স্তরে ‘ঝাঁকুনি’ দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন, তখন বিরোধী শিবিরের ছবি একেবারে উল্টো। বিজেপিতে আকচাআকচি লেগেই রয়েছে। হারার পরে দিলীপ ঘোষ বলছেন, তাঁকে ‘কাঠি’ করা হয়েছে। শুভেন্দু অধিকারী এবং দিলীপের ‘বাহিনী’ সমাজমাধ্যমে সম্মুখসমরে নেমেছে। সিপিএম এখনও অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলো খোঁজার প্রক্রিয়ায় রত। কংগ্রেসের বৈঠকে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিবিধ মত উঠে এসেছে। কেউ বলেছেন বামেদের সঙ্গে চলতে হবে। কেউ বলেছেন একলা চলো। কেউ আবার তৃণমূলের সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক মেরামতির আওয়াজ তুলেছেন।
বিরোধীরা অবশ্য মমতার প্রশাসনিক তৎপরতাকে প্রত্যাশিত ভাবেই কটাক্ষ করেছেন। রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদ তথা রাজ্যে পদ্মশিবিরের প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন, ‘‘তৃণমূলে যে অসুখ বাসা বেঁধেছে, তার কোনও প্রতিষেধক নেই। তৃণমূলও সেটা জানে। মুখ্যমন্ত্রী যতই চেষ্টা করুন, তৃণমূলের বিসর্জন অবশ্যম্ভাবী।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘এ সব দেখে মনে হচ্ছে, ‘জয় করেও ভয় কেন তোর যায় না’! পুরসভা নিয়ে মমতার উদ্বেগের কারণ ২০২২ সালে লুটের ভোট। পুরসভা ভোটে যে মানুষের প্রকৃত রায় প্রতিফলিত হয়নি, তা স্পষ্ট। তাই ওঁকে এত মাথা ঘামাতে হচ্ছে।’’ পাল্টা শাসকদলের নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল মানে অবিরাম শুদ্ধিকরণ। তাই মানুষের কাছে তৃণমূলের কোনও বিকল্প নেই। জয়ে আমাদের মাথা ঘুরে যায় না। আমরা দেখি কোথায় খামতি। দল-সরকার মিলেমিশে সেই খামতি মেটানোর কাজ শুরু করেছে।’’
লোকসভা ভোটে গ্রামাঞ্চলে যেমন তৃণমূল মজবুত সমর্থন পেয়েছে, তেমনই শহরাঞ্চলে শাসকদলের ভোটের ভিত ‘নড়বড়ে’ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের ১২১টি পুরসভার ৬৯টিতে এগিয়ে বিজেপি। দু’টিতে কংগ্রেস। বাকিগুলিতে তৃণমূল। কলকাতা, বিধাননগর, আসানসোল, শিলিগুড়ির মতো ‘কর্পোরেশন’ এলাকার ভোটের পরিসংখ্যান তৃণমূলের জন্য ‘উদ্বেগজনক’। সে কারণেই ফলঘোষণার পরে পক্ষকাল কাটার আগেই প্রশাসনিক স্তরে নাড়াচাড়া শুরু করেছেন মমতা। পুরনিগমের মেয়রদের ডেকে পুর পরিষেবায় ‘গাফিলতি’ নিয়ে তিরস্কার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি দফতরে বিদ্যুতের ‘অপচয়’ নিয়েও কড়া বার্তা দিয়েছেন। তার পরেই শিক্ষা দফতর বিজ্ঞপ্তি জারি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিদ্যুৎ অপচয় নিয়ে সতর্ক হতে বলেছে।
২০২১ সালের ভোটেও শহর, মফস্সলে তৃণমূল দেওয়ালে লিখত ‘চকচকে রাস্তা, ঝকঝকে আলো/ জনগণ বলছে তৃণমূলই ভাল’। কিন্তু রাজ্যের পুর এলাকার বৃহদাংশে রাস্তা, আলো, জঞ্জাল সাফ করার মতো ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবাগুলির ক্ষেত্রে ফাঁকফোকর দেখা যাচ্ছে। বিধাননগর পুরসভা এলাকার বিভিন্ন ব্লকের ভিতরে অধিকাংশ রাস্তার হাল খারাপ। ঝোপঝাড় নিয়মিত সাফ করা হয় না। যা থেকে রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। বৈঠকে ন্যূনতম পুর পরিষেবা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল প্রশাসনের একাংশকে। তার প্রেক্ষিতে শহর এলাকায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইছে শাসকদল এবং সরকার। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘কোভিডের কারণে পুরসভা ভোটের নির্ঘণ্ট বদলেছিল। সারা রাজ্যে পুরসভায় ভোট হয়েছিল ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কলকাতায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। ফলে ২০২৬ সালে সঠিক সময়ে বিধানসভা ভোট হলে তার আগে দল কোনও টেস্ট পরীক্ষা পাবে না। একেবারে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে হবে। দুর্গাপুর, হাওড়ার মতো কিছু জায়গায় ভোট বকেয়া রয়েছে। কিন্তু সেই ভোট দিয়ে সার্বিক শহরাঞ্চলের ছবি বোঝা মুশকিল। সে কথা ভেবেই দিদি পদক্ষেপ করতে শুরু করেছেন।’’
সরকারি জমি ‘বেহাত’ হওয়া নিয়েও কড়া বার্তা দিয়েছেন মমতা। কেন জবরদখল রোখা যাচ্ছে না, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়েছেন পুলিশকর্তারাও। সরকারি খাসজমি দখল হওয়া রুখতে চার সদস্যের কমিটি গড়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে রয়েছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল, অর্থসচিব মনোজ পন্থ, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) মনোজ বর্মা এবং আইএএস অফিসার প্রভাত মিশ্র।
ইউরো কাপ ফাইনাল আগামী ১৫ জুলাই। ‘প্রেসিং ফুটবল’ খেলে স্পেন চ্যাম্পিয়ন হবে কি না, তা ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে বোঝা যাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা সে দিক দিয়ে খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থায়। তাঁর ‘প্রেসিং ফুটবল’ খেলার জন্য বছর দুয়েক সময় রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy