দুর্গাপুজো আয়োজকদের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার নিউ টাউনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
জ্বালানির আগুন দরে আমজনতার ক্ষোভ আঁচ করে দীপাবলিতে পেট্রল ও ডিজ়েলে উৎপাদন শুল্ক সামান্য হলেও ছাঁটাইয়ের পথে হেঁটেছে কেন্দ্র। তার পরে এ বার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফেও যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট) কমিয়ে সুরাহার দাবিতে সোমবার পথে নামল রাজ্য বিজেপি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ওই দাবি ‘অসার’। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সাধারণ মানুষকে সুরাহা দিতেই গত তিন বছরে শুধু তেলের খাতেই নিজের করের ভাগ থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ছেড়ে দিয়েছে রাজ্য। কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে বিভিন্ন খাতে প্রাপ্য টাকা থেকে রাজ্যকে বঞ্চিত করে চলেছে, তাতে এই মুহূর্তে নতুন করে করছাড় দেওয়া রাজ্যের পক্ষে শক্ত বলেই তাঁর ইঙ্গিত।
মমতার বক্তব্য, “রাজ্য তিন বছর ধরে প্রতি লিটার তেলের দামে এক টাকা করছাড় (ভ্যাটে ছাড়) দিয়ে রেখেছে। তাতে ইতিমধ্যেই রাজস্ব আদায় কম হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। অথচ কেন্দ্রের কাছে বিভিন্ন খাতে রাজ্যের যা পাওনা, সেই টাকা পাওয়া যায় না।... আমরা টিকা পাই না, টাকাও পাই না।’’
রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রশ্ন, কেন্দ্র প্রতি লিটার পেট্রল, ডিজ়েলে উৎপাদন শুল্কে যথাক্রমে ৫ এবং ১০ টাকা ছাড় দিয়েছে। এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলিও পেট্রোপণ্যে ভ্যাট কমিয়ে স্বস্তি দিয়েছে। তা হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভ্যাটে ছাড় দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে না কেন? পঞ্জাব, ছত্তীসগঢ়ে নিজেদের সরকারের শুল্ক কমানোর উদাহরণ তুলে ধরছে কংগ্রেসও। এ রাজ্যেও একই দাবি তুলছে তারা।
কিন্তু মমতার পাল্টা সওয়াল, আমপান, ইয়াস, আইসিডিএস, মিড ডে মিল থেকে শুরু করে একশো দিনের কাজ— কোনও ক্ষেত্রেই রাজ্যকে প্রাপ্য টাকা দেয় না কেন্দ্র। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্র হয় বরাদ্দ বন্ধ করেছে কিংবা কমিয়ে দিয়েছে। তাই যাঁরা ভ্যাটের প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের জানা উচিত, আমরা কী পাই আর অন্যরা কী পায়।’’ একই সঙ্গে তৃণমূল মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা শুল্ক রাজকোষে তোলার পরে এখন উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ার পরে কর নামমাত্র কমিয়েছে মোদী সরকার। বাংলার ভোটে ভরাডুবির পরে ও রকম আরও ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কাতেই এই সিদ্ধান্ত।
মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল এ কথা বললেও, এ দিন পেট্রোপণ্যে রাজ্যের কর কমানোর দাবিতে বিজেপি তাদের রাজ্য দফতর থেকে মিছিল বার করে। সেই কর্মসূচিতে দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সর্বভারতীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ শীর্ষ নেতারা ছিলেন। কোভিড পরিস্থিতির জন্য পুলিশ ওই কর্মসূচিতে অনুমতি দেয়নি। মিছিল শুরুর আগেই দলের রাজ্য দফতর ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলে তারা। ফলে বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা দলের রাজ্য দফতরের সামনের রাস্তা মুরলীধর সেন লেনে জড়ো হন। সেখানে ম্যাটাডোরের উপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন সুকান্ত, দিলীপ, শুভেন্দু। সুকান্ত কর্মীদের উচ্ছৃঙ্খলতা না করে গণতান্ত্রিক ভাবে আইন অমান্য করার নির্দেশ দেন।
বিজেপি কর্মীরা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে, পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তি, বচসা হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশকর্তারা ঘোষণা করেন, উপস্থিত বিজেপির নেতা, কর্মীদের সেখানেই গ্রেফতার করে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের কথা মেনে মুরলীধর সেন লেনে মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পুড়িয়ে কর্মসূচি শেষ করে বিজেপি। দলের আট কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ লালবাজার সেন্ট্রাল লক আপে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বিজেপি আজ, মঙ্গলবার পেট্রল পাম্পে সচেতনতামূলক প্রচার করবে।
সুকান্ত বলেন, “কেন্দ্র পেট্রোপণ্যের শুল্কে কত ছাড় দিয়েছে আর রাজ্য কত ভ্যাট নিচ্ছে, সে সব আমরা মানুষকে জানাব। ...এক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্য ভ্যাট না কমালে, নবান্ন অভিযান করব।” শুক্রবার পর্যন্ত জেলাগুলিতেও পেট্রোপণ্যের উপরে ভ্যাট কমানোর দাবিতে আন্দোলন করবে বিজেপি। সুকান্ত এবং শুভেন্দু জানিয়েছেন, উৎসবের মরসুম শেষ হলে কলকাতায় এবং রাজ্যের অন্যত্র বিদ্যুৎ মাসুল কমানোর দাবিতেও আন্দোলনে নামবে দল।
উল্টো দিকে, সীমিত সঙ্গতিতে রাজ্যের সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে মমতা বলেন, ভ্যাট থেকে রাজ্যের যে টুকু আয়, তা বন্ধ করে দেওয়া (এই মুহূর্তে) খুব কঠিন।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও অবশ্য রাজ্যের কাছে পেট্রোপণ্যে ভ্যাট কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে বাজারে আগুন লেগেছে। সার, বীজের দাম-সহ সব কিছুর খরচ বাড়ছে। এর মূল কারণ পেট্রল, ডিজ়েলের দাম বৃদ্ধি। কেন্দ্র তাদের কর কিছুটা কমিয়েছে। এ বার মানুষকে স্বস্তি দিতে রাজ্যও ভ্যাট কমাক।” এ প্রসঙ্গে পঞ্জাব এবং ছত্তীসগঢ়ের সরকারের উদাহরণ দিয়ে অধীর বলেন, “ওই দুই রাজ্যের কংগ্রেস সরকার মানুষের সুরাহার জন্য তাদের করে অনেকটা ছাড় দিয়েছে।”
তৃণমূল-সহ বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ে প্রতি লিটার পেট্রল ও ডিজ়েলে উৎপাদন শুল্ক ছিল যথাক্রমে ৯.৪৮ ও ৩.৫৬ টাকা। সেখানে হালে ছাড় দেওয়ার আগে তা বেড়ে পৌঁছেছিল ৩২.৯০ এবং ৩১.৮০ টাকায়। এখন তা ২৭.৯০ ও ২১.৮০ টাকা। তাদের অভিযোগ, বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দর দীর্ঘ দিন তলানিতে থাকার সময়ে তার সুবিধা আমজনতার ঘরে পৌঁছতে দেয়নি কেন্দ্র। পরিকাঠামো-সহ বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে অর্থ জোগাড়ের যুক্তিতে সেই সময়ে টানা বাড়িয়ে গিয়েছে উৎপাদন শুল্ক। অথচ এখন আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দর মুখ তোলার সময়ে আর সেই শুল্ক অনেকখানি ছাঁটাইয়ের নাম করছে না তারা। উল্টে কর কমানোর দায় চাপিয়ে দিতে চাইছে রাজ্যগুলির উপরে। কোভিডের কামড়ে এমনিতেই যাদের রাজকোষের দশা বেহাল।
সুকান্ত এ প্রসঙ্গে ইউপিএ জমানার পেট্রোলিয়াম-বন্ডকে নিশানা করে বলেন, “মনমোহন সিংহের মতো নামী অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ইউপিএ সরকার ওই বন্ডের মাধ্যমে মানুষের উপরে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল। তা এখন বইতে হচ্ছে মোদী সরকারকে।” মূলত ওই বন্ডের টাকা শোধের বাধ্যবাধকতার কারণেই তেলে শুল্ক কমানো যাচ্ছে না বলে প্রচারে নেমেছে বিজেপি। কখনও বলছে টিকার টাকা জোগাতে চড়া করের কথা। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর পরেও মোদী জমানায় তেলের উপরে কর এবং সেস কী ভাবে প্রায় ৩০০ শতাংশ বাড়ল, তার স্পষ্ট উত্তর কেন্দ্রের কাছে নেই বলেই বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy